Halloween Costume ideas 2015

স্বাধীনতার স্বপ্নেরা / রেজাউল করিম খান


১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বাঙালির পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। তবে মনে মননে, চিন্তা চেতনায় স্বাধীন হওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল প্রবল। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভে সেই প্রমাণ মেলে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধনীর তালিকায় নাম লেখাতে থাকে, অচিরেই বুঝতে পারে তারা আবারও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। বনেদি পরিবারের রাজনীতিকদের সাথে এরাই মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবিতে আন্দোলন করেছে। পাকিস্তান চেয়েছে মনে প্রাণে। কিন্তু দেশভাগের পরই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি হিন্দু-মুসলমনকে বিজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি গেলাতে সচেষ্ট হয় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি। ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। শুরু হয় আন্দোলন। বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচনে শাসকদল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তুরের ছাত্র-গণঅভ্যূত্থান, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচন, সবশেষে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই সময়কালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ সংবাদপত্রের লেখা বিশ্বাস করতো।
সবাই স্বপ্ন দেখে। তবে মধ্যবিত্তরা বোধকরি একটু বেশিই দেখে। তারা বড় হতে, উপরে উঠতে চায়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ভীতু, দোদুল্যমান, সুবিধাবাদী, আপসকামী। যে স্বপ্নের জাল বোনা হয়েছিল বায়ান্নর রাজপথে, একাত্তরে এসে তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পঁচিশ বছর দর কষাকষি আর প্রস্তুতির পরিকল্পপনায় কেটে গেছে। এই সময়ে বাংলায় বয়ে গেছে রক্তগঙ্গা। অবশ্য ঔপনিবেশিক শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতন মানুষকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু কি ছিল সেই স্বপ্ন? পূর্ব বাংলার সিংহভাগ মানুষের ভাত-কাপড়ের সমস্যাতো ছিলই। চাহিদা ছিল বাসস্থানের, একটু চিকিৎসা আর সন্তানের সামান্য লেখাপড়া। সমস্যা ছিল মধ্যবিত্তেরও। ছিল উপরে ওঠায় নানা বাধা। গণতন্ত্র তখনও সাধারণ মানুষের নাগালে ছিল না, এখনও নেই। মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসকের কাছে তা আশাও করে না। তবে রাজনীতি ছিল, ক্ষমতার রাজনীতি। ক্ষমতা একটি বিশেষ শ্রেণিকে টাকার যোগান দেয়, জন্ম হয় পেশী শক্তির। আবারও ক্ষমতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ববাংলার মানুষ এমনটি ভাবেনি। সকল শ্রেণি পেশার মানুষ তখন বিপন্ন ছিল। ছিল মৃত্যুভয়ে ভীত। এমনই এক বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে জীবন দেয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিল লক্ষ লক্ষ কিশোর-তরুণ। তাদের অনেকেই বাড়ি ফিরে আসেনি আর। মায়ের কান্না থেমে গেছে কবেই। স্ত্রীও নিয়েছে বিদায়। তাদের স্বপ্নেরা এখন শূন্যে ভেসে বেড়ায় এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তেÍ     
ধর্মের নামে পাকিস্তান হয়েছে একথা ঠিক। কিন্তু বাংলা ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার বিষয়টি ভিন্ন। বাংলায় সাধারণ মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশই ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান চেয়েছে। নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পূর্ববঙ্গের কিছু সংখ্যক মুসলমান ব্যবসায়ী-শিল্পপতির স্বার্থের কথা চিন্তা করেই খন্ডিত বাংলায় নাজিমুদ্দিন-আকরম খাঁ সাহেবরা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ঐসময় কোলকাতার বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করতো পাঁচ লক্ষাধিক পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান শ্রমিক। জিন্নাহ্ সাহেবের দ্বিজাতিতত্বে বিশ্বাসী পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা ঐসব শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করেন নি। ভাবেন নি কৃষকদের কথাও। অথচ সাধারণ মানুষ চেয়েছে বাংলাকে অখন্ড রাখতে। সমাজতন্ত্রীরা চেয়েছে সোসালিস্ট রিপাবলিক ঘোষণা করতে। শরৎ বসু আবুল হাসেমের মধ্যে এব্যাপারে সমঝোতাও হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস-মুসলিম লীগের ইচ্ছাতে পাঞ্জাবের মত বাংলাও ভাগ হয়ে যায়। একটি ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে জেনেও তারা ঘৃণ্য কাজটি করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইউববিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীকার আন্দোলনের সূচনা হয়। মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ছাত্র-জনতার তীব্র গণঅভ্যূত্থানে আইউবের পতন হয়। পরবর্তী দেড় বছরে প্রচারণা প্রচেষ্টা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরার। ঐসময়ের কারামুক্ত শ্রেষ্ঠ সংগঠক শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে৭০-এর নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ফলাফল ছিল ভিন্ন। আইন যাই বলুক, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিলেন না। নানা অজুহাতে সময় পার  করা হচ্ছিল। বিষয়টি অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। এমনই এক সময়ে মওলানা ভাসনী পশ্চিমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানান। সাথে সাথে ছাত্রনেতারা শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করেন। এমতাবস্থায় দেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ৭ই মার্চে শেখ মুজিবের ভাষণ আগুনের ওপর পেট্রোল ঢেলে দেয়ার মত অবস্থা হয়। ততদিনে পাকিস্তানী সৈন্যরা পৌছে গেছে পূর্ব পকিস্তানের জেলা শহর গুলিতে। ২৫শে মার্চ ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যার পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল প্রতিরোধ যুদ্ধ। ২৫শে ফেব্রুয়ারি যে বিজয় ছিল সহজ, একমাস পর তা হয়ে গেল অনেক কঠিন। দামও দিতে হল অনেক। তো ১৯৭১ সালে যুদ্ধের আগে মানুষের দাবি প্রত্যাশা ছিল এক। যুদ্ধের সময় তা হয়ে গেল ভিন্ন। দীর্ঘদিন থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি চাইছিল। বস্তুত, সময় পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মত। বিষয়টি সাধারণ মানুষ যতটা না বুঝতে পেরেছিল, তার চেয়ে বেশি বুঝেছিল বাঙালি শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা। প্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।

সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনালগ্নে জনগণের যে চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেই চেতনার কিছুটা রদবদল হয়। চিন্তা থেকে চেতনার জন্ম। সময় মানুষ চিন্তা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন। পৃথক হওয়া নয়, বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবের ক্ষমতা গ্রহণ। সর্বোপরি সকল বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনার অবসান। কিন্তু ২৬শে মার্চ মানুষ পাকিস্তানী হায়েনাদের কবল থেকে মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি অসম যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হলেও সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ মুক্তি পায় নি। বিশেষ করে নির্যাতিত, নিপীড়িত শ্রমজীবি মানুষের মুক্তি হয় নি। অবশ্য স্বাধীনতার পর যে শ্রেণীর রাজনৈতিক দল বা সামরিক জান্তা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের পক্ষে মুক্তি দেয়া সম্ভব ছিল না। কারণ তারাই মুক্ত ছিল না। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ ছিল। এখনও অনেকে আছেন। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি বা দল নেই। যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের কাক্সিক্ষত মুক্তি দিতে পারে। তবে এখন দায়িত্ব নিতে হবে অন্যদের। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। দায়িত্ব নিতে হবে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে। যারা কৃষক-শ্রমিক, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির দাবিতে রাজপথ কাঁপাতে পারে। তাদের সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়বে প্রতিটি মেহনতি মানুষের ভাঙা ঘরের দরজায়। টগবগে তারুণ্যের উচ্ছাস সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ সেনাপতিমন্ডলীর।

Post a Comment

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget