প্রান্তজন রিপোর্ট: নাটোরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পাবলিসার্সের মোড়কে এবার নকল বা ডুপ্লিকেট গাইড বইয়ে সয়লাব হয়ে গেছে। স্থানীয় কিছু সংখ্যক অসাধু শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে এসব নকল বই বিক্রি করা হচ্ছে। এতে করে অভিভাবক সহ শিক্ষার্থীরা প্রতারিত হচ্ছে। স্থানীয় পুস্তক বিক্রেতা সমিতি বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নকল বই বিক্রেতাদের সনাক্ত করতে সার্চ কমিটি গঠন করলেও তোয়াক্কা করছে না কেউ। মূলত সকল পুস্তক বিক্রেতারা এই নকল গাইড বিক্রির সাথে জড়িত থাকায় তা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে। সমিতির সদস্যদের অভিযোগ , বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পাবলিসার্সদের নাম ভাঙ্গিয়ে ও তাদের মোড়ক সহ নকল বা ডুপ্লিকেট বই বগুড়া, নোয়াখালী এবং ঢাকাতেই ছাপানো হচ্ছে। এসব বইয়ের মূল্য কম হওয়ায় পুস্তক বিক্রেতারাও বেশী আগ্রহ দেখায়। কিন্তু পুস্তক বিক্রেতা সমিতির রক্ত চক্ষুর কারণে তা মূল বইয়ের সাথে গোপনে বিক্রি করা হয়। নাটোরে এসব নকল বা ডুপ্লিকেট বই জনতা, বই বিতান ও বাংলাদেশ লাইব্রেরীতে মজুদ করে তা বিক্রি করছেন। জনতা লাইব্রেরীর কর্মচারী এসব নকল গাইড বই মজুদ করে বাজারে বিক্রি করছেন। ইত্যবসরে পুস্তক বিক্রেতার পক্ষ থেকে এসব নকল গাইড বই বিক্রেতাদের সর্তক করতে নোটিশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু নোটিশ জারির পরও তা বন্ধ হয়নি। উপরন্তু তা বেড়ে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুস্তক বিক্রেতাদের কয়েকজন জানান, সমিতির সদস্যরাই সিন্ডিকেডের মাধ্যমে মূল বইয়ের সাথে এসব নকল বই বিক্রি করছেন।
ইতিমধ্যে মৌসুমের শুরু থেকে নাটোরে সিন্ডিকেডের মাধ্যমে বিভিন্ন পাবলিসার্সের পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, বিজয় ও ক্যাপ্টেন গাইড বই অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে। এসব বই বিক্রির জন্য বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দকে মোটা অংকের অর্থ ঘুষ দেওয়া হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার সৃজনশীল গাইড ও ব্যাকরণ বিক্রির জন্য গোপনে অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে স্ব স্ব এলাকার নির্দিষ্ট লাইব্রেরী থেকে।
জনতা লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেনের পক্ষে দোকান কর্মচারী কামরুল ইসলাম নকল গাইড বই মজুদ করে বিক্রি করার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবী করে জানান, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যেভাবে তাদের বই দিচ্ছেন তারাও সেই ভাবে বাজারে বই বিক্রি করছেন। আর শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাহিদার কারণে তারা অনুশীলন জাতীয় গাইড বই বিক্রি করছেন। তিনি বা তার মালিক কোন নকল বা ডুপ্লিকেট বই মজুদ বা বিক্রি করেননা বলে দাবী করেন।
এদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে গাইড বই কিনতে না পেরে সিংড়া উপজেলার পাঁচ লাড়–য়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা আর্থিক দৈন্যতার কারণে তার ছেলে পাঁচ লাড়–য়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র শামিউল বসির জন্য গাইড বই কিনতে পারেননি। গাইড বই না থাকায় তার ছেলে লজ্জায় নিয়মিত স্কুলে যায়না। জেলার প্রায় স্কুলের দিনমজুর পরিবারের শিক্ষার্থী গাইড বই কিনতে না পেরে স্কুলে নিয়মিত যাচ্ছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সদর উপজেলার ছাতনী হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক এন্তাজ আলী জানান, তার স্কুলের কোন শিক্ষার্থী গাইড বইয়ের জন্য স্কুলে আসছে না এমন সত্যতা নেই। তিনি দাবী করেন, তার স্কুল সহ জেলার প্রায় সকল স্কুলের শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। স্কুল থেকে গাইড বই কিনতে বুকলিস্ট দেওয়া হয়না।
দায়িত্বশীল একটি সুত্রে জানা যায়, সামি পাবলিসার্স, বেস্ট পাবলিকেশন, স্মরনি প্রকাশনী, প্রগতি প্রেস এন্ড পাবলিকেশনসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর সৃজনশীল গাইড, ইংলিশ গ্রামার, লেকচার, পাঞ্জেরী, অনুপম, বিজয়, ক্যাপ্টেন, সিসটেমেটিক গাইড, হোম টিউটর বাংলা ব্যাকরণ ও গ্রামার বই বিক্রির জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের চাপ দেওয়া হচ্ছে। স্কুুল কর্তৃপক্ষ এজন্য স্কুলের নাম বিহীন বুকলিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের হাতে। সুত্রটি আরো জানায়, গোটা মৌসুমে এসব গাইড ও ব্যাকরণ বই বিক্রির জন্য সিংড়ার শিক্ষক সমিতিকে ৪০ লাখ ৭০ হাজার টাকা, বাগাতিপাড়া সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা ও নলডাঙ্গা শিক্ষক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ প্রদান করা হয়েছে। সদর সহ গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এসব গাইড বই বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই অবৈধ অর্থ হজম করতে শিক্ষার্থীদের হাতে গাইড ও ব্যাকরণ বইয়ের বুকলিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। নাটোরের মাডাণ লাইব্রেরী এই সিন্ডিকেডের পুস্তক সরবরাহ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে আরাও জানাযায়, শিক্ষার্থীদের টার্গেটে রেখে নতুন বছরের শুরুতেই জেলা সদর সহ প্রতিটি উপজেলায় বইয়ের দোকানে অবৈধ গাইড বইয়ে সয়লাব হয়ে যায়। লাইব্রেরীগুলোতে প্রকাশ্যে চলছে নিষিদ্ধ এসব গাইড বইয়ের প্যাকেজ ব্যবসা। নির্দিষ্ট প্রকাশনার প্রতিনিধিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ম্যানেজ করে শিক্ষার্থীদের এসব গাইড কিনতে উৎসাহিত করছে। এজন্য তারা শিক্ষক সমিতিসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করছে। প্রকাশন প্রতিষ্ঠান ও পুস্তক বিক্রেতাদের গড়া সিন্ডিকেডের কবলে পড়ে অভিভাবকদের বই কিনতে গিয়েও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। জেলা সদরে পাওয়া যায়না উপজেলার শিক্ষার্থীদের বই। স্ব স্ব উপজেলায় নির্দিষ্ট লাইব্রেরিতে এসব গাইড বই কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বা এজেন্টরা স্থানীয় পুস্তক ব্যবসায়ীদের সাথে অলিখিত চুক্তি করে বিভিন্ন উপজেলা সদরে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। স্ব-স্ব উপজেলার বই নির্দিষ্ট ওই কোম্পানী ছাড়া অন্য কোন কোম্পানীর বই বিক্রি করছেনা পুস্তক বিক্রেতারা। আর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বুকলিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকদের এই চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম। এই সব প্যাকেজ গাইড বই কিনতে গিয়ে নতুন করে প্রতারণা সহ বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা। আসল বইয়ের দামে নকল গাইড ও ব্যাকরণ বই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে পুস্তক বিক্রেতা সমিতি নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকরা এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অপপ্রচার বলে দাবী করেছেন।
মর্ডাণ লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী মহিবুল আলম তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে উদ্যেশ্য প্রণোদিত ও মিথ্যাচার বলে দাবী করেন। তবে নকল বা ডুবলিকেট গাইড বই বিক্রির সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি জানান, পুস্তক বিক্রেতা সমিতি থেকে সর্তক নোটিশ দেওয়া হলেও বিক্রি থামানো যাচ্ছেনা। সকলের মত তিনিও এসব গাইড বই বিক্রি করছেন। কোন সিন্ডিকেডের সাথে জড়িত নন। তারা পাবলিসার্সদের কাছে জিম্মি। মুক্তধারা লাইব্রেরীর সত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীনও নকল গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নকল গাইড বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি, তিনি কোন নকল গাইড বিক্রি করছেন না।
সিংড়া উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আফছার আলী এসব অভিযোগকে ভিতিহীন ও বানোয়াট দাবী করে বলেন, সমিতির কোন নেতৃবৃন্দ গাইড বই কেনার জন্য স্কুল শিক্ষকদের কোন নির্দেশনা দেননি। যেহেতু গাইড বইয়ের কোন প্রয়োজন নেই । সেখানে সিন্ডিকেড করার অভিযোগ কল্পণাপ্রসুত।
নাটোর জেলা পুস্তক বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলী হোসেন নকল গাইড বই বিক্রির সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, এসব নকল বই বিক্রি বন্ধে সমিতির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে তিনি আক্ষেপ করে জানান, এই নকল গাইড বই বিষয়ে পাবলিসার্স প্রতিনিধিদের কোন উদ্যোগ নেই। সমিতির পক্ষ থেকে সার্চ কমিটি সহ সর্তক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তিনি গাই বই বিক্রির বিষয়ে বলেন, অনুশীলন জাতীয় গাইড বই বিক্রির জন্য দীর্ঘদিন ধরে তারা আন্দোলন করে আসছেন। এবিষয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা চলমান আছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকদের চাহিদার কারণে তারা এসব গাইড বই বিক্রি করেছেন।
জেলা শিক্ষা অফিসার আমজাদ হোসেন জানান, নকল অথবা কোন ধরনের গাইড বই বিক্রি বা স্কুল থেকে বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে এমন কোন অভিযোগ তিনি পাননি। বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে গাইড বই আছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। গাইড বোর্ড বিক্রি নিষিদ্ধ থাকার পরও যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসব বই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য বা পরামর্শ দিচ্ছেন তার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে যথাপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সহ লাইব্রেরীগুলোতে অভিযান চালানো হবে বলে জানান তিনি।

Post a Comment