Halloween Costume ideas 2015

মনে পড়ে বাবাকে / নবীউর রহমান পিপলু


১৯৭১ সাল। নাটোর সহ সারা দেশ তখন উত্তাল বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে সব শ্রেণী-পেশা ধর্ম-গোত্রের মানুষ জয়বাংলা বলে পাকিস্তানি হায়নাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ নিয়ে রাজপথে নেমে শ্লোগান দিতে থাকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। একাত্তরের মার্চ রেসকোর্স ময়দানেএবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রামবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন ঘোষনার পর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে রাজপথে নেমে আসে সবাই। ওই দিন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর নাটোরের সর্বস্তরের মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ন্যাপের স্থানীয় প্রয়াত নেতা খন্দকার আবু আলীকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। সুকলপট্টি এলাকায় সে সময়ের নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ হোস্টেলে বর্তমানের রাণী ভবানী সরকারী মহিলা কলেজে কাঠের রাইফেল (ড্যামী) দিয়ে চলতে থাকে প্রশিক্ষণ। অনেকের সাথে আমিও যাই সেখানে। আমার বাবা মরহুম খন্দকার রশীদুর রহমানও উদ্বুদ্ধ হন যুদ্ধে যাওয়ার। ছোট খাটো সরকারী চাকরী করতেন, তাই সময় সুযোগ হলেই বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে শরীক হতেন। চাকরী করতেন নাটোর সদর হাসপাতালের সিনিয়র নার্স পদে। ফুটবল বা ক্রিকেট টিমের মত আমরা ছিলাম ১১ জন ভাই-বোন। এর মধ্যে বোন ভাই আমরা।  অবশ্য ৭১- মুক্তিযুদ্ধের সময়  বাবার সংসারে আমি সহ সদস্য সংখ্যা ছিল জন। পরে সদস্য সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। যেদিন বিজয় অর্জিত হয় অথাৎ ৭১ এর বিজয় মাসে আমার এক ভাইয়ের জন্ম হয় ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জলংগি শরনার্থী ক্যাম্পে। তখন আমি ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে বগুড়ার রণাঙ্গনে অবস্থান করছিলাম। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসার পর বাবা-মা সহ অন্য ভাই-বোনেরা নতুন বাংলাদেশে আসলে ওই ভাইয়ের জন্মের কাহিনী জানতে পারি। জলংগিতে মুক্তিযোদ্ধা শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকারের সহায়তায় প্রবাসী সরকার একটি চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করলে বাবা সেখানেই চিকিৎসা সেবা কর্মে রত ছিলেন। সেই কারণে তিনি জলংগি শরনার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করেন। তবে আমি বাবা-মার সাথে ছিলাম না। আমি পশ্চিম দিনাজপুরের কুড়মাইল মালঞ্চিতে পাবনার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বেড়া এলাকার তৎকালীন এমসিএ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ভাইয়ের ই্য়থ ক্যাম্পে অবস্থানের পর দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মুহকুমার নকশাল বাড়ি এলাকায় পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পে  আর্টিলারি (উচ্চতর) প্রশিক্ষণের পর ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিই। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের অযোদ্ধা সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করি এবং নওগাঁ, পাচঁবিবি, হিলি প্রভৃতি এলাকায় ঢুকে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়। এসময় নাটোর তৎকালীন জিন্নাহ মডেল হাইস্কুলের (বর্তমানের সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মদন মোহন তালুকদারের সাথে বালুর ঘাটে প্রায় সাক্ষাৎ হত।  পরে ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। এজন্য  বাবা-মার খবর রাখতে পারিনি। স্বাধীনতার পর জলংগির সাবরামপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া সহযোদ্ধাসহ অনেকের কাছে জেনেছি আমার বাবার দেশ প্রেমের  কাহিনী। বাবাও বলেছেন ভারতে অবস্থানের সময় নানা কাহিনী। সেখানে কেমন ছিলেন, কার কার সাথে দেখা হয়েছে, ভারতীয়রা কেমন আচরণ করেছে। তবে তিনি আক্ষেপ করতেন সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে না পারার দুঃখ যন্ত্রনার কথা। ভারতের মাটি তার নিজ ভূমি হওয়া সত্বেও কোন সজনের বাড়িতে বাস করেননি। দেশের টানে অন্যদের মত পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শরণার্থী ক্যাম্পে। সেই বাবাকে হারিয়ে অসহায়ত্ব কেটেছে বহুদিন। জন্ম মৃত্যু যেখানে সত্য, তাই তার শূন্যতা  মেনে নিলেও তাকে মনে পরে প্রতিনিয়ত। ৭১ এর স্মৃতিতে সেই বাবাকে এখন বার বার মনে পড়ে
জলংগি শরনার্থী ক্যাম্পের পাশেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। সাবরামপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প নামে ওই ক্যাম্প পরিচালিত হয় সেসময়। ওই ক্যাম্পে অন্যদের মধ্যে নাটোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালীন কমান্ডার শেখ আলাউদ্দিন, মরহুম খন্দকার আব্দুর রাজ্জাক, ফজলুর রহমান, টিপু চৌধুরী আমার প্রতিবেশী মোহিত দাস ধোপার ছেলে স্কুল বন্ধু দিলীপ কুমার দাস সহ অনেকেই প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের সাথে আমার বাবার দেখা হয়েছে প্রতিনিয়ত। স্বাধীনতার পর শেখ আলাউদ্দিন মরহুম খন্দকার রাজ্জাকের কাছে জেনেছি, আমার বাবা সময় পেলেই তাদের  ক্যাম্পে ছুটে গিয়েছেন সময় কাটাতে। সঙ্গে নিয়ে যেতেন শুকনো খাবার বিড়ি। ক্যাম্পে অবস্থান করা অন্য জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচিত হতেন। তাদের চাহিদা অনুযায়ী সাধ্য মত কখনও বিড়ি বা শুকনো খাবার, সাবান ওষধ দিয়ে আসতেন।  ক্যাম্পের কোন যোদ্ধার অসুস্থ হওয়ার খবর পেলে তিনি ছুটে যেতেন ক্যাম্পে এবং চিকিৎসা সেবা সহ ঔষধ দিয়ে আসতেন।
শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন বলেন, রশীদ ভাই ছিলেন একজন মুক্তিকামী মানুষ। যুদ্ধে যেতে না পারলেও তিনি ৭১ এর মাস মুক্তিযোদ্ধা শরনার্থীদের যে সেবা দিয়েছেন তা ভোলার নয়। তিনি একজন বীর যোদ্ধা।  তবে দীর্ঘ নয়মাস বাবা ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে শরণার্থী মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে তিনি ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর  আমাদের মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মুহকুমার পানিঘটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আমি যখন আর্টিলারি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম সেই সময় গেলিরা যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য পানিঘাটা ক্যাম্পে দেখা হয় বন্ধু দিলীপ কুমার দাসের সাথে। সেখানে তার কাছে জেনেছি জলংগি শরণার্থী ক্যাম্পে আমার  বাবা-মা থাকেন। প্রশিক্ষণ শেষে অবশ্য কয়েকদিনের ছুটি পাওয়ায় বাবা-মার সাথে দেখা করতে জলংগি ছুটে গিয়েছিলাম। রেল পথে  প্রায় দুদিনের পথ অতিক্রম করে যেদিন জলংগি শরনার্থী ক্যাম্পে বাবার মুখোমুখি হই সেদিন যেন নতুন করে বাবাকে জানলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত ডুকরে কাঁদলেন। গর্ভধারীনি মাও সেদিন ছেলে বেঁচে আছে জেনে আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। বাবা-মা আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলেন না।  একদিন তাদের সাথে কাটিয়ে ফিরে আসতে হয় বালুরঘাটের অযোদ্ধায় অবস্থান নেওয়া রণাঙ্গনের জন্য গঠন করা  ব্রেভো সেক্টরের তুফানি ব্যাটেলিয়নে (মুক্তিযুদ্ধের নং সেক্টরের অধীন) ফেরার পথে মনের স্মৃতি স্পটে ভেসে বেড়াতে থাকে শিশু শৈশবকালে বাবা-মার আদর সোহাগের কথা। একসময় মনে পড়ে ৭১ এর মার্চ ঢাকার রেসকোর্স মাঠের বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর নাটোর সহ যখন গোটা দেশ স্বাধীনতার জন্য উত্তাল,তখন বাবার সাথে আমিও রাজপথে শ্লোগান দিয়েছি। মনে পড়ে নাটোরে প্রথম প্রতিরোধের সময় অবাঙ্গালি অধ্যুষিত শহরের চকবৈদ্যনাথ, বেলঘরিয়া নেঙ্গুরিয়া এলাকায় পাকসেনাদের অবস্থানের খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দেয়। নাটোরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ চলার সময় এপ্রিল দলছুট পাকসেনাদের একটি ছোট দল বনবেলঘরিয়া এলাকায় অবাঙ্গালীদের পাড়ায় অশ্রয় নিলে মুক্তিযোদ্ধা সহ জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। খবর আসে অবাঙ্গালি হাফেজ আব্দুর রহমানে নেতৃত্বে অবাঙ্গালিরা পাকসেনাদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় দলছুট কয়েকজন পাকসেনাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এই খবরে মুক্তিকামী বাঙ্গালীরা ওই তিনটি এলাকায় চড়াও হলে বাঙ্গালি-বিহারীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় বেশ কিছু অবাঙ্গালি নারী-পুরুষ আহত হয়। মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের প্রতিরোধের মুখে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তৎকালীন এমসিএ  প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরীসহ সেময়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আহতদের উদ্ধার করে বর্তমানের সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় আলাইপুরস্থ বর্তমানের পরিত্যক্ত সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যায়ে এনে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে বালক বিদ্যালয়ে পুরুষদের এবং বালিকা বিদ্যালয়ে নারী শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নাটোর সদর হাসপাতালের সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত আমার বাবা ওই দুই কেন্দ্রে অবাঙ্গালীদের চিকিৎসা সেবায় অংশ নেন। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ আমার বাবা সেময় অবঙ্গালীদের চিকিৎসা দিতেও অনিহা দেখাননি। তিনি মানুষ হিসেবে তাদের চিকিৎসা সেবায় যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় কাজের চাপে কখনও কখনও বাড়ি ফিরতে পারেননি বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আমি বাবার কাছে গিয়েছি বাবা জানতে চাইতেন কারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যেদিন নাটোর টেজারি ভেঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরন করা হয়,সেদিনও বাবাকে দেখেছি হাসপাতালের ডিউটি ছেড়ে উৎসুক মানুষের সাথে হাসপাতালের পাশে অবস্থিত তৎকালীন টেজারি চত্বরে গিয়ে ছোটাছুটি করতে। ওই দিন টেজারি চত্বরে দেখেও বাবা আমাকে কিছুই বলেননি। উপরন্তু সাহস যুগিয়েছেন হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। এরই ফাকে তৎকালীন মুহাকুমা প্রশাসকের কার্যালয় কাচারি মাঠের ফ্লাগ হোস্টিং জয়বাংলা খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
৭১ প্রথম প্রতিরোধের সময় পাকসেনাদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার উদ্যেশ্যে নাটোর শহরের বিভিন্ন প্রবেশ পথে প্রতিবন্ধক তৈরি করা হয়। কিন্তু ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। ১৩ এপ্রিল থেকে পাকসেনারা শহরে প্রবেশ করে বাঙ্গালী নিধনের নামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।  মুক্তিকামী মানুষগুলো নিরাপত্তার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাড়ি জমাতে শুরু করে। প্রশিক্ষিত সেনা ভাড়ি অস্ত্র গোলাবারুদের সামনে যুদ্ধে জয় সম্ভব নয় এবং প্রাথমিক পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে ১২ এপ্রিল রাতেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সহ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ভারতে পাড়ি জমান। ১৩ এপ্রিল সকাল থেকে বিষয়টি প্রচারিত হতে থাকলে আতংকিত হয়ে পড়েন অনেকেই। নেতৃত্বশুন্য হয়ে পড়ায় মুক্তিকামী মানুষগুলো যে যেভাবে পেড়েছেন শহর ছাড়তে থাকেন। বাবার নির্দেশে একটি ঘোড়া গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসি। পরে সেই ঘোড়া গাড়িতে ( স্থানীয় ভাষায় টমটম) করে আমার পরিবার ভারতের উদ্যেশ্যে রওনা হয়। এসময় আমার প্রতিবেশীদের অনেকেই সঙ্গি হয়। সারদা পুলিশ একাডেমী হয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই রওনা হই পথে অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয়। কোথায় যাচ্ছি আমরা, কেন যাচ্ছি ,হিন্দু মুসলমান সব একসাথে কেন- এমন প্রশ্ন ছিল অনেকের সত্য মিথ্যা বলে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন আমার বাবা। একসময় সারদা ক্যাডেট কলেজের সামনে গিয়ে আমারা ঘোড়া গাড়ি ছেড়ে দিই। সেখানে আগে থেকেই আরো বেশ কিছু পরিবার ভারতে পাড়ি জমানোর উদ্যেশ্যে অবস্থান করছিলেন। বাড়ি থেকে বেধে নিয়ে যাওয়া খাবার খেয়ে পদ্মা নদী পারাপারের জন্য নৌকা খুজতে থাকে আমার বাবা। তাকে আমি সহ অন্যরাও সাহায্য করেন। এসময় সেখানে আসেন এক ইপিআর ( বর্তমানের বিজিবি) যোদ্ধা। তিনিই খুজে আনেন একটি নৌকা। নৌকার মাঝি জানান, পাকসেনারা  সারদার উদ্যেশ্যে রওনা হয়েছে। বেশী দেরী করলে আর যাওয়া যাবেনা। বিপদ হবে। ওই কথা শোনার পর থেকে মনে আতংক বেড়ে যায়। বুঝতে পেরে বাবা আমাদের সবাইকে শান্তনা দিতে থাকেন। নারী সদস্যদের কেউ কেউ আতংকে কাঁদতে থাকেন ফঁস ফঁস করে। নৌকা ছেড়ে দেওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে অনেকের মনে। কিন্তু নদীর মাঝপথে মাঝির নির্দেশ শুনে আৎকে উঠতে হয়। নদীর প্রায় মাঝামাঝি বা তার বেশী অংশ অতিক্রম করার পর মাঝি নৌকা থেকে সবাইকে নামতে বলেন। জিজ্ঞাসা করতে মাঝি জানায়,নৌকা আর নেওয়া যাবেনা। নদীতে পানি কম থাকায় এই বিপত্তি বুঝতে পেরে সবাই নেমে পড়ি। নৌকার মাঝি অভয় দিয়ে বলেন এটি ভারতের অংশ। নদীতে হাঁটু পানি। একটি চর দেখিয়ে বললেন, প্রায় এককিলোমিটার নদী পথে হেঁটে যাওয়ার পর ওই চর পাওয়া যাবে। ওই চরের ওপারে ভারতের ধনীরামপুর গ্রাম। মাঝির দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী পানি পথেই নারী শিশুদের নিয়ে হাঁতে শুরু করি সবাই। আবারও বিপত্তি বাধে বৃদ্ধারা যখন পানিতে নেমে হাঁতে পারছিলেননা। বাধ্য হয়ে তাদের জনকে কোলে নিয়ে নদী পার করতে হয়। একসময় চরের দেখা মেলে কিন্তুর ওপর প্রান্তে আবার পানি দেখে সবাই ভড়কে যাই। শান্তনা খুজে পাই চরে কর্মরত সাঁওতাল নারী শ্রমিকদের কথায়। তাদের একজন আমাদের সাথে নিয়ে যেদিকটায় পানি কম সেই প্রান্ত দিয়ে নিয়ে নদী পারাপারে সাহায্য করেন।  একসময় ধনীরামপুর গ্রামে ঢুকে পড়ি। সেখানে একটি বাড়িতে প্রকৃতির কাজ শেষে রওনা হই অবশ্য খাওয়া দাওয়ার পর্বটাও সেরে ফেলা হয় ওই গ্রামেই। গ্রামের মানুষদের আতিথিয়তায় আমরা মুগ্ধ হই। নারী-পুরুষ শিশু সহ আমারা ছিলাম প্রায় ২০/২৫ জন গ্রামের মানুষই আমাদের রান্না করে খাওয়ায়। পরে তারা আমাদের  মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর যাওয়ার বাসে উঠিয়ে দেন। যে বাসটিতে আমরা উঠি সেই বাসেই দেখা মেলে নাটোরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর সেনানী কামরুল ইসলাম, মজিবর রহমান সেন্টু অনাদি বসাকের সাথে। বহরমপুর নেমে আমারা সবাই শরনার্থীদের জন্য স্থাপনকরা সরাইখানায় গিয়ে অবস্থান নিই। তবে কামরুল ভাইদের সাথে আর দেখা হয়নি। পদ্মপাতায় করে সরাইখানার গিলো খিঁচুরি খেয়ে উঠতেই দেখা হয় নাটোরের অবিসংবাদিত প্রয়াত নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর সাথে। বাবাকে দেখ এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করে বাবাকে কুশল জিজ্ঞাসা করেন। কোথায় যাব বা থাকব সে বিষয়ে জানতে চাইলেন। একে এক নাটোরের প্রত্যেকের সাথে তিনি সাক্ষাত করেন। অনেকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এক সময় বহরমপুরের কাদাই এলাকায় আবার বাবার ফেলে আসা  নিজস্ব সম্পত্তির বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা হই। সেখানে গিয়ে পরিচিত হই বাবার সজনদের সাথে। কিন্তু দেশের টানে দিন পরেই আমি চলে যাই পাবনার তৎকালীন এমএনএ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ পরিচালিত বালুরঘাটের কুড়মাইল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখান থেকে পরে চলে যাই মালঞ্চ ক্যাম্পে। পরে গেরিলা আর্টিলারি প্রশিক্ষনের জন্য পাড়ি জমাতে হয় পানিঘাটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। এর পর থেকে বাবা-মা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় কয়েকমাস।
যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, হিলি, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ি হয়ে বগুড়ায় অবস্থান করি। ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া শত্রুমুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর নাটোরে আসি। কিন্তু তখনও নাটোর শত্রুমুক্ত হয়নি। ২১ ডিসেম্বর নাটোর শত্রুমুক্ত হয় পুরোপুরি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যবর্তনের দিন পর বাবা-মা ভারত থেকে দেশে আসেন। বাবা দেশে আসার পরই তার পুর্বের কর্মস্থলে যোগদেন। ইত্যবসরে আমি বগুড়ায় ফিরে যাওয়ায় বাবা-মার সাথে তখন দেখা হয়নি। পরে বগুড়ার পুলিশ লাইন ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে  নাটোরে ফিরে  আসলে বাবা-মার সাথে দেখা মেলে। যুদ্ধ থেকে জীবিত ফিরে আসতে দেখে ছেলের প্রতি  বাবা-মার আদরে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। একসময় পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবা তার পুর্বের কর্মস্থল নাটোর সদর হাসপাতালে কাজে যোগদেন এভাবেই কেটে যায় কয়েকটি বছর। কিন্তু বাবা তার মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের রোমঞ্চ মুছে ফেলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প শোনাতে সন্তানদের নিয়ে আড্ডায় বসতেন। আমার বৃদ্ধা নানিও গল্প শুনতে বসে পড়তেন। এক সময় আমার পালা এলে যুদ্ধোর নানা কাহিনী বলতাম। সবাই শুনতো আর রোমাঞ্চ অনুভব করতেন। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে একসময় বাবা ভুলে যেতে বসেন ৭১ -এর স্মৃতি। সংসারের চাপ বেশী হওয়ায় এক সময় পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানাগত হন তিনি। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিকামী মানুষ হয়েও বাবাকে কখনই সরকারী সুবিধার জন্য দৌঝাঁপ করতে দেখিনি। অনেকেই সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্য তাকে বলতেন। তিনি বলতেন আমি দেশের জন্য ভারতে গিয়েছিলাম কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেইনি। তাই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে চাইতেন না। কিন্তু যখন দেখতেন তার কাছে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প শুনেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন। তখন তিনি কষ্ট পেতেন। বলতেন মিথ্যাচার করে বেশীদিন টিকে থাকা যায়না। তার সেই সরল কখাগুলো সত্যি হয়েছে কম। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তৎকালীন এমসিএ নাটোরের অবিসংবাদিত নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী কাকা তাকে বলতেন বাপ-বেটা মুক্তিযোদ্ধা গর্ববোধ কর রশিদ ভাই তুমি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে নেও। কাকার অনুরোধও প্রত্যাখান করেছেন হাসি মুখে। আমরা পরিবার থেকে তাকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহের জন্য বার বার বলেছি কিন্তু তিনি তা উড়িয়ে দিয়েছেন,বলেছেন মুক্তিকামী মানুষের সনদ পাওয়া গেলে তা সাদরে গ্রহণ করবেন। তবে মৃত্যুর পুর্ব মহুর্তে উপলদ্ধি করেছেন কেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেননি। শেষ দিকে এসে বলতেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলে আনন্দ পেতমন। কথা জড়িয়ে যাওয়ায় ইশারায় বোঝাতেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা কেউ বিশ্বাস না করলে আমারা যেন তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান করি। আমরা পরিবারের সকল সদস্য তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান জানালেও রাষ্ট্রিয় সম্মান পাননি তিনি। সেই দুঃখ কষ্ট এখনও আমাদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। বাবার ইচ্ছার কারনে স্থানীয় সহযোদ্ধাদের কাছে ঘুরেছি বাবাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু তার জন্য সনদ সংগ্রহ করতে না পারায় বাবার শেষ ইচ্ছা পুরন করতে পারিনি। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার দীর্ঘ তালিকায় আমার বাবার নাম নেই এমন কথা  বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তবুও সত্যতা মেনে বাবাকে সম্মান  জানাতে কার্পণ্য করি না। প্রতিবছর বিজয় স্বাধীনতা দিবসে বাবাকে স্যালুট করে  সম্মান জানায় একজন বীর যোদ্ধা হিসেবে। যোদ্ধা বাবা আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের পরিবারের। তাই এবারের বিজয় দিবসেও বড় বেশী মনে পড়ছে বাবাকে। তবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বাবার নাম থাকবে এমনটা বিশ্বাস নিয়ে এবারের বিজয় দিবসে বাবাকে জানায় সম্মান সুচক স্যালুট।


নবীউর রহমান পিপলু
নাটোর প্রতিনিধি
সমকাল/ইটিভি
মুক্তিযোদ্ধা
মোবাইল-০১৭১১-৯৫৫৬৯৮




Post a Comment

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget