Halloween Costume ideas 2015

ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির নারীদের বেঁচে থাকার লড়াই


সজল কুমার হোড়, গুরুদাসপুর: ভোরের আলো ফুটতে তখনো বেশ বাকি। তবুও জীবিকার তাগিদে হাতে কাস্তে, কোদাল আর ধান বহনের বাক নিয়ে জড়ো হয়েছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির হাজারও নারী শ্রমিক।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের নয়াবাজারশ্রমিকের হাটেরপ্রতিদিনের দৃশ্য এটি। হাট থেকে শ্রমিক কিনে কৃষক নিয়ে যাচ্ছেন জমিতে। সেখানে গিয়ে কেউ ধান কাটছেন, বাকে করে ধান বহন করছেন কেউবা আবার কর্দমাক্ত মাটিতে রসুন রোপন করছেন।
শ্রম বিক্রি করতে আসা শ্রমিকের একজন চল্লিশ পেরোনো বিজলী ওরাঁও। তার অভাবের কাছে হার মেনেছে সব প্রতিকুলতা। সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়া থেকে দশ টাকা ভাড়ায় ট্রাকে চরে এসেছেন গুরুদাসপুরেরশ্রম বাজারেশ্রম বিক্রি করতে। শ্রম বিক্রি করেছেন ঠিকই, কিন্তু পাননি ন্যায্য মুজুরী। ধারাবাহিক মুজুরী বৈষম্যের গল্প বিজলী ওরাঁও-এর একার নয়। দরিদ্রতার কালো আগুনে ঝলসে যাওয়া হাজারও নারী শ্রমিকের বেঁচে থাকা লড়াইয়ের প্রতিদিনের গল্প। 
বিজলী ওরাঁও জানান, তাদের এলাকা অপেক্ষাকৃত নিচু। সেখানে ইরি-বোরো আবাদ ছাড়া চলতি মওসুমে কোন কাজ নেই। তাই গুরুদাসপুরে রসুন রোপন, ধানকাটাসহ সকল কাজ করতে এসেছেন। এই দলের সাথে আসা কলেজ ছাত্রী রাখীটক্কির মতে, তারা নিজের খেয়ে মজুরিপান ২০০ টাকা। অথচ অন্য সম্প্রদায়ের মহিলারা কৃষকের খেয়ে একই মজুরি পেয়ে থাকেন। আবার পুরুষ শ্রমিকরা ৪০০ টাকা করে মুজুরী পান। অভাবের তারনায় মুজুরী বৈষম্য মেনে নিয়েই প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই করছেন তারা।
আদিবাসী সংগঠনের নেতাদের সাথে কথাবলে জানাগেছে,- চলনবিলের গুরুদাসপুর, সিংড়া, তাড়াশ, রায়গঞ্জ উপজেলা এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি বসবাস করে। এদের মধ্যে উড়াও, মাহাতো, রাজবংশী, বিদাস, কনকদাস স্বল্প সংখ্যক সাঁওতাল ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি নারী-পুরুষ রয়েছে। এক সময় এসব সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ বনজঙ্গলে ঘুরে শিয়াল, খরগোস, বেজি, কচ্ছপসহ নানা ধরনের প্রাণি বধ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সময়ের ব্যবধানে বন-বাদার উজার হয়ে পড়ায় তাদের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সংসার চালাতে জীবিকা হিসাবে তারা ধান লাগানো, কাটা, মাড়াই, ইটভাটায় শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ বেছে নেয়। কঠোর পরিশ্রমী, সহজ-সরল আর অপেক্ষাকৃত কমদামে শ্রমিক পাওয়ায় অঞ্চলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিদের চাহিদা অনেক বেশী।
হেমন্ত শরতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিদের এলাকায় কাজ থাকে না। সময় উপেক্ষাকৃত উচু এলাকায় মাঠে ধান কাটা, বহন, বিনাহালে রসুন রোপনের কাজ শুরু হয়। অঞ্চলের ৮০-৮৫ ভাগ ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি কৃষি শ্রমজীবি। কম মুজুরীতে কৃষি শ্রম বিক্রি করেই তাদের সংসার পরিচালনা করতে হয়।
ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি নেতাদের দাবি,-বর্ষাকালিন সময়ে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠিকে ভিজিডি, ভিজিএফ, বষস্কভাতার সুবিধা প্রদানসহ বিশেষ কর্মসুচীর আওতায় এনে পুর্নবাসন করা। অন্যথায় এসব জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো অভাব মেটাতে নানা রকম অপরাধ মুলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গুরুদাসপুরের মাঠে কাজ করতে আসা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির নারী শ্রমিক শ্যামলী রানী কুমারী আল্পনা রানী জানায়, সকাল থেকে ৪টা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন শ্রম দিয়ে তারা মুজুরী পাচ্ছেন ১শ ৫০ থেকে ২শ টাকা। তাতে কোন রকমে বেছে রয়েছেন।
খুটিগাছা গ্রামের আদিবাসী মুমতি মাহাতো জানান, ভাদ্র, আশ্বিন কার্ত্তিক মাসে তাদের কোন কাজ থাকে না। সময় অর্থ সংকটে পরে অল্প দামে শ্রম বিক্রি করতে হয়। কিংবা চড়াসূদে টাকা নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে অনেকেই ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
শনিবার নয়াবাজেরর শ্রমিকের হাটে গিয়ে জানাগেল, গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম ছাড়াও তাড়াশ, সলঙ্গা উল্লাহপাড়া বগুড়া শেরপুর উপজেলা এলাকার নারী শ্রমিকরা দল বেঁধে এখানে জমায়েত হয়। এসব শ্রমিকদের সবাই এসেছে ট্রাক-বাসের ছাদে, নছিমন কিংবা অটোভ্যানে। সকলের গায়েই রয়েছে শীতের পোষাক, হাতে কাস্তে, কোদাল ধান বহনের জন্য বাক। পাশ দিয়েই সাইঁ সাইঁ করে চলছে বাস-ট্রাক। কৃষক তাদের চাহিদামত শ্রমিক দরদাম মিটিয়ে সরাসরি নিয়ে যাচ্ছেন মাঠে।
মজিবুর রহমানসহ পাঁচজন কৃষকের সাথে কথাবলে জানাগেছে, ধান কাটা, বিনাহালে রসুন রোপন, সেখানে লারা (ধানের খড়) বিছানোসহ জমি তৈরির কাজ করানো হয় এসব শ্রমিক দিয়ে। তাছাড়া স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় কম মুজুরীতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির নারী শ্রমিকদের পাওয়া যায় বলে এদের কদর বেশি। 
নাটোর জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সভাপতি রমানাথ মাহাতো জানান, চলনবিলে বসবাসরত আদিবাসীদের ঘরে ঘরে অভাব চলছে। নিরুপায় হয়ে তারা কম মুজুরীতে শ্রম বিক্রি করছেন। অনেকে গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। 
আদিবাসী ফাউন্ডেশনের (তাড়াশ) সভাপতি জানান, তাড়াশ এডিপি ওয়ার্ল্ড ভিশন নামে একটি বে-সরকারী সংস্থা আদিবাসীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে হাঁস-মুরগী, ছাগল, গাভী পালন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ পরিবারের আয় মূলক কর্মকান্ডের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুদান ঋণ প্রদান করত। কিন্তু গত প্রায় বছর ধরে এনজিও নির্ভর সহযোগীতা অনেকটা বন্ধ হওয়ার কারণে আদিবাসী নর-নারীদের কম মুজুরীতে শ্রম বিক্রির প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Post a Comment

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget