বিপ্লব কুমার পাল
জেলা পর্যায়ে সংবাদপত্র
প্রকাশের চেয়ে
টিকে থাকাই
সবচেয়ে কঠিন।
অনুন্নত জেলা
বিশেষ করে
সেখানে শিল্প
কারখানা নেই,
পৃষ্ঠপোষকতার বড় অভাব সেখানে এই
টিকে থাকার
যাত্রাটা হয়
ভয়ংকর। তবে
সংগ্রাম করে
টিকে থাকতে
পারে, তাদের
হাতেই থাকে
জয়ের পতাকা।
রানীভবানী কিংবা বনলতা,
চলনবিল বা
কাঁচাগোল্লার এই নাটোর বাংলা ভাষাভাষিদের
কাছে পরিচিতি।
যেটি অন্য
জেলার বেলায়
সম্ভব হয়নি।
প্রাচীন শহর।
শিক্ষা-সাহিত্য
এক সময়ের
অগ্রসরের জেলা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য আসর কিংবা
পলাশের প্রান্তরে
সৈন্য পাঠানোর
ইতিহাসে উজ্জ্বল
নাটোর। কিন্তু
সেসব ইতিহাস।
বর্তমানে এর
মিলে খুঁজে
পাওয়া কঠিন।
শিক্ষা- সাহিত্য-রাজা-জমিদারের রাজত্ত্ব
কিংবা যোগাযোগে
এগিয়ে থাকা
নাটোর এখন
অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া জেলা। যদিও
সরকারে যারা
থাকেন সেসব
রাজনৈতিক দলের
নেতারা তা
মানতে পারে
না। সামাজিক
আন্দোলনের সেই তেজও আর নেই।
গ্যাসের দাবিতে
আন্দোলন শুরু
হলেও তার
ফসল তুলতে
পারেনি নাটোরবাসী।
আশ্বাস আর
হুমকিতে আন্দোলনকারীরা
আর মাঠে
নামেনি। আশ্বাসের
মুলা ঝুলে
রইলো নাটোরবাসীর
সামনে।
নাটোরের গণমাধ্যমও দুর্বিসহ
সময় পার
করেছে। এখনও
যে করছে
না তা
নয়। নাটোরের
সাহিত্য পত্রিকা
ইতিহাস খুবই
উজ্জ্বল। পেয়েছে
রাজা-জমিদারদের
সহযোগিতা। কিন্তু ভারতবর্ষ ভাগ এবং
স্বাধীন বাংলাদেশে
সাহিত্য পত্রিকা
বের হয়েছে।
যদিও প্রকাশনা
নিয়মিত রাখতে
পারেনি বেশিরভাগ
পত্রিকা। মহকুমা
থেকে জেলা
হওয়ার পর,
সাংবাদিকতায় গুরুত্ব পায় নাটোর। শুরু
হয় আরেক
লড়াই। ঢাকার
প্রতিকার প্রতিনিধি
হয় অনেকে।
রাজধানী নয়, মফঃস্বল
শহর থেকেই
বাংলা সংবাদপত্রের
অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিলো। ১৮৪৭ সালে
রংপুর থেকেই
বেড়িয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর
বার্ত্তাবহ’। বাংলাদেশের তৃতীয় সংবাদপত্র
প্রকাশিত হয়
মফঃস্বল শহর
রংপুর থেকেই।
১৮৫৬ সালের
১৮ এপ্রিল
ঢাকা থেকে
‘ঢাকা নিউজ’
প্রকাশিত হয়।
এটি বাংলাদেশের
দ্বিতীয় সংবাদপত্র।
গ্রামের মানুষের
সুখ, দুঃখ,
হাসি-কান্নার
সংবাদ এবং
অভাব-অভিযোগ,
দাবি, প্রত্যাশার
সংবাদ প্রকাশে
প্রথম উপলব্ধি
করেন কাঙাল
হরিনাথ মজুমদার।
১৮৬৩ সালের
এপ্রিল মাসে
তিনি ‘গ্রামবার্তাপ্রকাশিকা’
প্রকাশিত করেন।
মফঃস্বল সংবাদপত্রের
ইতিহাস গুরুত্বপুর্ণ
অবদান রেখেছে
রাজশাহী বোয়ালিয়া
ধর্মসভার মুখপত্র
‘হিন্দুরঞ্জিকা’। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত
হয় ১৮৬৮
সালের এপ্রিল
মাসে। ৮০
বছর ধরে
পত্রিকাটি একটানা প্রকাশিত হয়েছিলো।
এবার আসি আমাদের
নাটোর প্রসঙ্গে।
বেশ কয়েকটি
সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হলেও
দৈনিক প্রকাশ
নাটোরের অন্যতম
পত্রিকা। অনুন্নত
প্রযুক্তিতে ছাপতে বেশ বেগ পেতে
হয়েছে উদ্যোক্তাদের।
এরপর দৈনিক
উত্তরপথ প্রকাশিত
হয়। কিন্তু
তাদের যাত্রা
দীর্ঘ হয়নি।
এরপর নাটোর
থেকে প্রকাশ
হয় দৈনিক
উত্তরবঙ্গবার্তা। স্থানীয় আওয়ামী
লীগের প্রয়াত
নেতা হানিফ
আলী শেখ
এর সম্পাদক
ও প্রকাশক।
ভালো ছাপা
মেশিন না
থাকায় নিয়মিত
পত্রিকাটি ছাপা হতো বগুড়া থেকে।
এরপর ধীরে
ধীরে এর
কলেবর বাড়ে।
নিজস্ব মেশিনে
ছাপা হয়
উত্তরবঙ্গবার্তা। একবার রাজনৈতিক
চক্রান্তের শিকার হয় পত্রিকাটি। নিয়ম
না মেনে
বিএনপির সময়ে
পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
পরে আইনি
লড়াইয়ে জেতে
আবার প্রকাশিত
হয় উত্তরবঙ্গবার্তা।
সাফল্য আসে
সম্পাদকের ঘরে। কিন্তু সেই সুনাম
বেশি দিন
ধরে রাখতে
পারেনি পত্রিকাটি।
ছাপার মান
খারাপ হওয়ার
সাথে সাথে
সংবাদের গুণগত
মানও কমতে
থাকে। তবে
আশার কথা
পত্রিকাটির প্রকাশনা এখনো অব্যাহত আছে।
চারদলীয় জোট ক্ষমতায়
আসার পর
বিএনপি নেতা
রুহুল কুদ্দুস
তালুকদার দুলুর
সহযোগিতায় নাটোর থেকে প্রকাশিত হয়
দৈনিক জনদেশ।
ব্যবসায়ী ও
তখনকার বিএনপি
নেতা আব্দুল
মান্নাফের সম্পাদনায় পত্রিকায় যোগ জেলার
বেশ কয়েকজন
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
নিয়মিত বেতন
আর অফিস
সজ্জাও ছিল
ঈর্ষাণীয়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে
প্রকাশনা শুরু করলেও স্বর্ণময় দিন
তারা বেশি
দিন ধরে
রাখতে পারেনি।
তবে নানা
সমস্যার পরও
জনদেশ এখন
প্রকাশিত হয়,
এটিও গণমাধ্যম
কর্মীদের বড়
পাওয়া। এরপর
আরো দুটি
দৈনিক প্রত্রিকার
প্রকাশনা শুরু
হয়। একটি
দৈনিক উত্তরকণ্ঠ,
আরেকটি দৈনিক
প্রান্তজন। স্বচ্ছ ছাপার পাশাপাশি প্রতিকা
দুটোর প্রকাশনাও
নিয়মিত। এরমধ্যে
নিজস্ব প্রেস
বসিয়েছে প্রান্তজন।
নাটোরের পত্রিকায়
গুণগত পরিবর্তন
আসছে। এরমধ্যে
দৈনিক প্রান্তজন
তিন বছরে
পা রেখেছে।
প্রান্তজনের পথচলা সুন্দর হোক, শুভেচ্ছা
তাদের কর্মীবাহিনীকে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সূচনা
হয়েছিলো আঞ্চলিক
সংবাদপত্র থেকেই। একারণে আঞ্চলিক সংবাদপত্রের
প্রয়োজন বেড়েছে
কিন্তু কমেনি।
যদিও এসব
সংবাদপত্র সেই প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ
হচ্ছে। আগামীদিনের
আঞ্চলিক সংবাদপত্রকে
সমৃদ্ধ করার
জন্য বেশ
কিছু পদক্ষেপ
নেয়া প্রয়োজন।
আঞ্চলিক পত্রিকার
মালিকদের প্রথমে
বুঝতে হবে,
তিনি যে
সংবাদপত্র প্রকাশ করতে যাচ্ছেন সেই
পত্রিকা পাঠকের
প্রত্যাশা কতটুকু পুরণ করতে পারবে।
সবার আগ্রহ
থাকলে পত্রিকা
প্রকাশনায় নামতে পারেন। তবে প্রথম
দিন থেকেই
লাভ নেওয়ার
চিন্তা ত্যাগ
করতে হবে।
আধুনিক প্রিন্টিং
ব্যবস্থা স্থাপন
করতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন
ভাতা পরিশোধ
করতে হবে।
বস্তুনিষ্ঠ, নিরেপেক্ষ আঞ্চলিক সংবাদ সুন্দর
কাগজে ঝকঝকে
ছেপে পাঠকের
হাতে পৌঁছাতে
হবে। আঞ্চলিক
পত্রিকা বিকাশের
জন্য বাণিজ্যিক
ব্যাংকের ‘সংবাদপত্র ঋণ’ ব্যবস্থা চালু
করা যেতে
পারে। মালিক
অথবা সম্পাদক
সার্টিফিকেট জমা রেখে এই ঋণ
গ্রহণ করতে
পারেন। ঢাকায়
দেয়াল সংবাদপত্র
না করে,
সেই টাকায়
নিজ জেলায়
একটি সংবাদপত্র
প্রকাশ করতে
পারেন। এতে
করে আঞ্চলিক
সংবাদপত্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো মজবুত
হবে। মফঃস্বল
সাংবাদিকরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সন্ত্রাসী এবং
প্রশাসনের রোষানলে পরেন। মন্ত্রী, প্রশাসন
এবং রাজনৈতিক
নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের আঞ্চলিক সংবাদপত্রের
উপর তাদের
অনৈতিক হস্তক্ষেপ
বন্ধ করতে
হবে।
আঞ্চলিক সংবাদপত্রের বিকাশের
জন্য আমাদের
এভাবে এগিয়ে
যেতে হবে।
এটি করা
সম্ভব। চারণ
সাংবাদিক মরহুম
মোনাজাত উদ্দিনের
মতো সাংবাদিকরা
যারা গ্রাম-বাংলায় বিরাজ
করছেন, তাদের
হতে হবে
আঞ্চলিক সংবাদপত্রের
মূল কা-ারী। এইভাবে
একদিন আমাদের
আঞ্চলিক সংবাদপত্র
ফিরে পাবে
তার হারানো
ঐতিহ্য।
বিপ্লব কুমার পাল:
গণমাধ্যম কর্মী

Post a Comment