বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি
ঘোষণার পর বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ৬ আগস্ট এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।
স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে
৫০২ জনের নাম আছে আর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে আছেন ৭৩ জন। বিএনপির ইতিহাসে এটিই
সবচেয়ে বড় কমিটি। অনেকে বলছেন, সকলকে খুশি রাখতে এতো বড় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন খুশি
রাখতে হবে, খুশি না রাখলে কী সমস্যা হবে, এমন প্রশ্নে অবশ্য কোনও নেতা মুখ খোলেন নি।
তবে দলের স্থায়ী কমিটিতে প্রথমবারের মতো মনোনীত আমীর খসরু মাহমুদ চোধুরী মনে করেন,
বিগত বছরগুলোতে সরকারের দমননীতির কারণে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী নানাভাবে হয়রানির
শিকার হয়েছেন। দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে নির্দিষ্ট সময়ে
বিএনপির কাউন্সিল হয়নি। এর মধ্যে নেতা হওয়ার মতো কর্মীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বর্তমান
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক নেতা নানারকম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেকে
জীবন বাজি রেখেছেন। মেধাবী তরুণ, নারী ও অন্যান্য পেশাজীবীর কথাও ভাবতে হয়েছে। ফলে
কমিটি বড় হয়েছে। এই কমিটি আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে যথার্থ ভূমিকা রাখবে।
নতুন কমিটি ঘোষণার পর প্রথম যে
বিষয়টি আলোচনায় আসে তা হচ্ছে, কয়েকজনের পদত্যাগ ও পদবঞ্চিতদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ। নাম প্রকাশের পরপরই চেয়ারপারসনের ্উপদেষ্টা মোসাদ্দেক
আলী ফালু ও সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম পদত্যাগের ঘোষণা দেন। নতুন কমিটিতে
ভাইস চেয়ারম্যান পদ পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি আব্দুল্লাহ আল নোমান। পদত্যাগ করতে পারেন
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য গোলাম আকবরও। কমিটিতে স্থান না হওয়ায় জিয়া পরিষদ থেকে পদত্যাগ
করেছেন সংগঠনের সহকারী মহাসচিব অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার। কমিটিতে স্থান না হওয়ায় যুবদলের
কেন্দ্রীয় নেতা এসএম জিলানী সোমবার সকালে তার সমর্থকদের নিয়ে বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয়
কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেন। জয়নাল আবেদীন ফারুক ও নব্বুইয়ের গণআন্দোলনের কয়েকজন ছাত্রনেতাও
কমিটির সমালোচনা করেছেন। এসবই এসেছে নানা প্রচার মাধ্যমে। খবর সংগ্রহ ও প্রকাশে কিছু
ভুল ত্রুটি থাকতে পারে, তবে নতুন কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির অভ্যন্তরে এমনই চলছে। অনেকে
বলছেন ছোট আকারের কমিটি হলেও পদবঞ্চিতদের মান অভিমান থাকত। এপ্রসঙ্গে দলের মহাসচিব
ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিল বেগম খালেদা জিয়াকে দলের
কার্যনির্বাহী কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়। এই কমিটি নিয়েই বিএনপি আগামী তিন বছর রাজনৈতিক
কর্মসূচি পালন করবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে।
ভাবনার বিষয় এই যে, বিএনপি একটি
গণতান্ত্রিক দল কিনা, দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় খাকাকালে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল কিনা
এবং বতমানে তাদের দলের মধ্যে গণতন্ত্রে চর্চা আছে কিনা। এখানে স্মরণ করা যায়, ১৯৭৮
সালের ১ সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী
দল (বিএনপি) গঠন করেন। ক্ষুদ্র কয়েকটি দলের সুযোগ সন্ধানী কিছু ব্যক্তি ঐ দলে যোগ দেন।
তাদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীও ছিল। ছিল ডান, বাম ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক। তিনি
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ব প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি মত প্রকাশ করেন, বাংলাদেশে নানা মত ও ধর্মের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠি বাস করে। তাদের
সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা ভিন্ন। তাই ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূথ-ের ভিত্তিতেই
জাতীয়তাবাদকে গ্রগণ করা উচিত। তাঁর দলে রাজনীতিতে নতুন ও তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি।
তিনি তাদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এই ধরনের একটি
কর্মশালা উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, “কোনও রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে
না। অবদান থাকতে পারে। পাকিস্তান আমলে ধর্মকে
নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছিল, তা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম শুধু ধর্মই।” তিনি মুখে একথা বললেও
তাঁর সময়ে বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির সূচনা হয় এবং শাখা প্রশাখায় বিকশিত হয়। তিনি
সব দলকে রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। কিন্তু তাঁর দলে গণতন্ত্রের চর্চা
ছিল না। তাঁর নির্দেশেই দল পরিচালিত হতো। এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে।
স্বায়ত্বশাসন ও বাঙালির অধিকার
প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে যেমন পুর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্তদের
সমর্থন পেয়েছিল, তেমন ধর্ম ও ভারত বিরোধিতার আওয়াজ তুলে বিএনপি সাধারণ অসচেতন মানুষের
সমর্থন অর্জনে সক্ষম হয়। এই সমর্থন নিয়ে কয়েকবার রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বিএনপি
এখন ধনীদের দল। অনেক নেতা দলের পদ পদবির জন্য অর্থ ব্যয় করতে কাপর্ণ্য করেন না। তবে
বর্তমান সরকারের পুলিশ-র্যাবের মারমুখি আচরণের কারণে আন্দোলনে নামতে ভয় পান। বিক্ষোভ
মিছিল এড়িয়ে চলেন। কমিটি ঘোষণার পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। এই কয়দিন শুধু কমিটি নিয়ে
নেতাদের মান-অভিমান, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, ব্যাখ্যা-বিবৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
নতুন কমিটি কোনও বৈঠক করেনি, কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিও দিতে পারেনি। সহসা কোনও বৈঠক
হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বেগম খালেদা জিয়া আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে হজ পালনের জন্য সৌদি
আরব যেতে পারেন। এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠক হতে পারে। সেই বৈঠকে আন্দোলনের
কোনও কর্মসূচি নেয়া হবে বলে মনে হয় না। কারণ এখন বর্ষাকাল।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি
একটি বড় রাজনৈতিক দল। দলটিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের যেমন ভীতি আছে, তেমন বিএনপির নেতাকর্মীরাও
ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু অতীতে একাধিক ভুলের কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি
তাদের। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে যারা বিএনপির নেতৃত্বে এসেছিলেন,
এবারও তারাই আছেন। কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে, কয়েকজন বার্ধক্যজনিত কারনে অবসরে গেছেন,
কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন। এদের সংখ্যা খুবই কম। দলের রণকৌশল নির্ধারণে এদের তেমন ভূমিকাও
থাকে না। আগামীতেও দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে আন্দোলনের কর্মসূচি
গ্রহণ করা হবে না বলেই ধারনা করা যায়। গুলশানের আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়া ঈদ জামাতের
ঘটনা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে শঙ্কিত
করেছে। নড়েচড়ে বসেছে সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখায় বিএনপি। নয়াপল্টনের কার্যালয়
থেকে শুধু বিবৃতি নয়, স্বয়ং দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব
দিয়ে একের পর এক বৈঠক করেছেন তাঁর দল ও জোটের শীর্ষ নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের সাথে।
অনেকদিন পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের সরব পদচারণাকে বিশেষ ইঙ্গিতময় বলেই মনে করা হয়েছিল।
জঙ্গি বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিও তৈরি করা হচ্ছিল। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও প্রস্তুতি
নিচ্ছিলেন, এই সুযোগে তারা মাঠে নামতে পারবেন। নীতিগত কারণেই সরকার বাধা দেবে না। পুলিশও
ধাওয়া করবে না। কিন্তু এরই মধ্যে মুদ্রা পাচার মামলায় হাইকোর্ট দলের ‘কা-ারী’ তারেক
রহমানের ৭ বছর জেল দিয়ে দেন। শিকেই ওঠে জঙ্গি প্রতিরোধ আন্দোলন। জরুরি হয়ে পড়ে তারেক
রহমানের সাজার প্রতিবাদ করা। সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকা মহানগরীসহ দেশের সকল মহানগর ও জেলা
সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হবে। এই আন্দোলন সফল হয়নি। এখন দেখার বিষয়
বেগম খালেদা জিয়া সৌদি আরব ও ল-ন সফর শেষে ঈদের পর দেশে ফিরে কী বর্মসূচি দেন।#
লেখক: সাংবাদিক।
তারিখ: ১১/০৮/১৬, মোবাইল: ০১৭১১৭৮৯৯৫৫

Post a Comment