মেইন রোড থেকে তিন রাস্তার মোড়ে
খানিকটা বৃত্তাকার এই ছোট্ট বাজারটায় যখন তারা বাস থেকে নামল তখন বেলা দুপুর গড়িয়ে
গেছে, বিকেল ছুঁই ছুঁই। মাথার উপরে পশ্চিমে খানিকটা হেলে পড়া সূর্যটা তখনও কটকটে রোদ
ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতির কথা। তখন ঘড়িতে পৌঁনে চারটা। লিখন তাকে জানিয়েছিল,
‘সুনয়নদা, অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল চারটায়, একটু আগে আগে আসার চেষ্টা করবেন।’ আগে আগে
আর আসা হল কোথায়! এখান থেকে তাদের যেতে হবে বামদিকে মানে উত্তরদিকের সিঙ্গেল রোড ধরে
বেশকিছু দূর ভিতরে, নড়াবাড়িয়া গ্রামে। এ এলাকার যানবাহন বলতে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ভটভটিÑ
নসিমন/করিমন। অবশ্য তাদের বহনের জন্য একটা মাইক্রোবাস থাকার কথা, চারদিকে চোখ বুলিয়ে
কোথাও সেটা চোখে পড়ল না। খানিকটা তেষ্টা পেয়েছিল, শর্ট টাইমে একটা চায়ের পর্বও সেরে
নিল। তারা চারজন সেখানে যাচ্ছে, সুনয়ন দেব, সাথে মহিদুল, স্বরূপ ও নাসির- তিনজনই নবীন
কবি ও গল্পলেখক। নাসির লিখনের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলল, জানা গেল মাইক্রোবাস পাওয়া
যায়নি। অগত্য তারা উঠে বসল সেই অদ্ভুত ধরনের ভটভটি গাড়িতে। গাড়িতে আলাদা সিট নেই, ভ্যানগাড়ির
মতো কাঠের শক্ত তক্তপোষই ঢালাও সিট। সুনয়ন দেব আর নাসির সামনে ড্রাইভারের একটু পেছনে
বসে, বাকি দুইজন পেছনে উল্টোমুখ হয়ে পা ঝুলিয়ে। খোলামেলা গাড়ি উড়োজাহাজের মতো উড়ে উড়ে
চলেছে যেন, যদিও সুনয়নের কোনোদিন উড়োজাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি তারপরও মনে হল সেরকমই
একটা কিছু। রাস্তার দুই পাশে ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ, গায়ে বেশ হাওয়া লাগিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল।
ভটভটির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানল পথ বেশি নাÑ পনের/কুড়ি মিনিট লাগবে যেতে। চারজন
টুকটাক করে কথা বলছে। বাতাসে অনেক সময় কথা ভেসে ভেসে হারিয়েও যাচ্ছে, মুখ ঘুরিয়ে কথা
ফের বলতে হচ্ছে। ড্রাইভারও মাঝে মাঝে চড়া-গলায় তাদের সাথে কথায় তাল মেলাচ্ছিল। নাসির
আর মহিদুলের জন্য একেবারে অপরিচিত এলাকা। আর স্বরূপের এখানে নানার বাড়ি, পাশে বোনের
বাড়ির এলাকা। আর সুনয়নের জন্য এই এলাকা একেবারে নতুন না এই কারণে যে এই পথ দিয়ে সে
একদিন মাত্র এই তিনমাথার মোড়ে এসেছিল! যাই হোক, সিঙ্গেল রোড ছেড়ে তারা যখন বামে ছোট
আরেকটা ডাল সড়কে ঢুকছিল তখন ভটভটি আচমকা ব্রেক করে দাঁড়ালে নাসির বলে বসল, ‘কী ব্যাপার,
এতো তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম নাকি!’ নাসিরের কথা ভুল প্রমাণ করল ড্রাইভার, না, এটা আরেকটা
বাজার। গাড়ি থামলে একজন যাত্রী নেমে গেল, দুইজন নতুন যাত্রী উঠল। আবারও ছুটে চলল ভটভটি।
গ্রামের মধ্যে দিয়ে সরু অথচ পাকা রাস্তা, দুই পাশে ফসলের আবাদি জমি, খানিকটা দূরে ধূরে
আকাশ পানে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির মধ্যে বাড়ি-ঘর দাঁড়িয়ে। মাঠের পর মাঠ সবুজে ভরপুর, জায়গায়
জায়গায় কিছুটা হলুদের আভাও চোখে পড়ে, কিছুদিনের মধ্যে ধান পাকার আভাস। ভটভটি গাড়িটা
একসময় ছোট একটা বাজারের ওপর এসে দাঁড়াল, ড্রাইভার জানাল- এটাই নড়াবাড়িয়া বাজার, সামনে
গ্রাম। সবাই ঝটপট নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। কোনদিকে যাবে এখন এটা নিয়ে কেউই ভাবিত না,
কারণ সবার কাছেই মোবাইলফোন আছে। লিখনকে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানালেই হবে। স্বরূপ
বলল, ‘খানিকটা আগে পাঠাগারের সাইনবোর্ড দেখেছিলাম, সেখানে নামলেও হতো মনে হয়...।’ মহিদুল
হঠাৎ করে বলল, ‘কেন? ওখানে মাংস পাক হচ্ছিল সেইজন্য নাকি?’ মহিদুলের কথায় সকলে হেসে
ফেলল একচোট। যাই হোকÑ অনুষ্ঠানস্থল খুঁজে পেতে সামান্যটুকুও বেগ পেতে হল না। ডানদিকে
চোখ ফেলতেই দেখা গেল বিশালাকৃতির একটা স্কুল মাঠের এক প্রান্তে বড় করে স্টেজ সাজানো,
যা সবাইকেই চমকে দিল। স্টেজের দুইপাশে বড় সাইজের সাউন্ডবক্স, স্টেজের ওপর সারি সারি
চেয়ার সাজানো। সামনে দর্শক সারিতে অনেকগুলো চেয়ার। বেশকিছু লোক বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাফেরা
করছে। অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি। পল্লী পাঠাগারের বৎসর পূর্তি উৎসব, ব্যাপক আয়োজন করে
তা পালন করা হচ্ছে। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আসবেন। কবি ও গল্পকার সুনয়ন দেব দুইযুগের
নিভৃতচারি সৃজনশীল সাহিত্যচর্চায় মাত্র একটি কবিতার বই আর দু’টি ছোটগল্পের বই-এর ওপর
ভিত্তি করে সম্প্রতি একটা লিটলম্যাগ গোষ্ঠির পুরস্কার পেয়েছে সে। লিখন, শহিদুলরা তাদের
এই পাঠাগারের বর্ষপূর্তিতে এই কারণে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে পাঠাগারের পক্ষ থেকে সম্মাননা
ও সংবর্ধনা দেবে বলে। সেও তাতে সম্মতি জানিয়ে এখানে এসেছে, আর তার সাথে ওরা।
সুনয়ন দেবের সাথে লিখনের প্রথম
পরিচয় মোবাইলফোনের মাধ্যমে। মাঝে মাঝে ও ফোন দিয়ে কথা বলত। তার বেশকিছু লেখা নাকি ও
পড়েছেও। এর মধ্যে একদিন দুপুরে লিখন আর শহিদুল একেবারে তার বাড়িতে হাজির। দু’জনের কাউকেই
চেহারায় চেনে না সে, চোখেও দেখেনি কোনোদিন। মোবাইল ফোনে কথা হয় মাত্র। যাই হোক ওদের
সাথে দেখা হল। কথায় কথায় ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলÑ কোনও কাজে আসা হয়েছে কি না। লিখন ও
শহিদুল দু’জনেই জানিয়েছিল, ‘না তেমন কোনো কাজে না। আপনার সাথে একটু দেখা করা আর একটু
কথা বলার জন্যই আসা।’ বছর চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সের সংসারী সুনয়ন দেব ওদের কথায় খানিকটা
অস্বস্তিতেই পড়ে গিয়েছিল আর কী। এখানে কোনও কাজ নাই অথচ তার মত একজন মানুষকে দেখা আর
কথা বলার জন্য এতটা দূর থেকে দুই কলেজ পড়–য়া তরুণ এসেছে। কী বলা যায় তাদেরকে? সুনয়ন
দেবের ভাল-লাগার শেষ থাকল না। ওদেরকে সম্মান করল, সামর্থ্যরে মধ্যে ওদেরকে আপ্যায়ন
করল। আলাপ হল সাহিত্য, সাহিত্য পত্রিকা দেশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ, কিছুটা বোধ হয় রাজনীতি
নিয়েও, আরো অনেকে অনেক বিষয় নিয়েও। চায়ের স্টলে বসে আড্ডা যেমনটি হয়, তেমনটিই। কিন্তু
তার নিজের বুকের ভেতর একটা কাঁটা ওরা বিধিয়ে দিয়ে গেল মনে হল, ‘একটু দেখা করা আর কথা
বলার জন্য ছুটে আসা।’ সুনয়ন দেব নিজ শহরেই একটা প্রতিষ্ঠানে ছোট একটা চাকুরি করেÑ এছাড়া
বলবার মতো তেমন কোনও পরিচয় তার নেই। পত্রপত্রিকায় একটু আধটু লেখালেখি করে বিধায় কেউ
কেউ নামে বা চেহারায় চেনে, এছাড়া অন্য কিছু তো নয়। নিজেকে বড় কিছু ভাবতে নিজের কাছে
লজ্জা লাগে তার। শহরের যেকোন অনুষ্ঠানের শেষ বেঞ্চে বসতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে, স্বস্তিতে
থাকে নিজেকে আড়ালে রেখে। আর তার মতো ঘরকুনো একজন মানুষকে দু-একজন মানুষও খোঁজ করে
বের করেÑ এটা তার কাছে বিস্ময়কর লাগে বৈকি!
তারা মাঠ সংলগ্ন গ্রামে প্রবেশের
পাকা রাস্তার ওপর দাঁড়াল। চোখের সামনে বাদাম, খুরমা, চানাচুর, জিলাপি, মিষ্টান্নসহ
হরেক পদের সারি সারি বেশ কিছু খাবারের দোকান। একটা মেলা মেলা ভাব। লিখনকে ডাকা দরকার
ভেবে নাসির ফোন দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু একি! ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, সংযোগ ঘটছে না। বাকি
তিনজন উৎকণ্ঠিত হয়ে নিজ নিজ ফোনে নজর দিল, না ঠিকই আছে তো! শুধু নাসিরের ফোনেই এই সমস্যা।
সুনয়ন দেব ফোন দিয়ে তাদের পৌঁছানোর খবরটা জানাতেই সে ‘এক্ষুণি আসছি’ বলে জানাল। মিনিট
পাঁচেক পর লিখন হাস্যমুখে সামনে হাজির। সুনয়ন লিখনের হাসি মুখটার দিকে চেয়ে থাকল। উসকো
খুসকো মাথার চুল, চোখমুখে ক্লান্তি আর পরিশ্রমের ছাপ। সে ছাপ তার জামা কাপড়েও, সেদিকে
তার নজর নেই। তাদের এখানে আসাতে সে আনন্দে আত্মহারা, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সেই সাথে
বারবার লজ্জা প্রকাশ করছেÑ মোড়ের ওপর তাদের নিয়ে আসার জন্য যে মাইক্রোবাসটি যাওয়ার
কথাছিল সেটি যেতে পারেনি। বিধায় কষ্ট করেই আসতে হল এইটুকু পথ! যাহোক, কুশল বিনিময় শেষে
তাদেরকে সামনের একটা চায়ের দোকানে নিয়ে দাঁড় করালো। চায়ের দোকানদার ভেতর থেকে বের হয়ে
এলে লিখন পরিচয় করিয়ে দিল। এশারত আলীÑ লিখনের বাবা। সুনয়ন দেব হাত তুলে আদাব জানালে
ভদ্রলোক হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। সেও হাত বাড়িয়ে তার আন্তরিকতাটুকু গ্রহণ
করল। লম্বাটে দেহের শান্তশিষ্ট, বিনয়ী ভদ্রলোক। তারা অনেক দূর থেকে এসেছে শুনে তিনি
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং চা খাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করলেন। সুনয়ন দেব বিনয়ের সাথেই
জানাল, ‘এখন আর না-খাই। যাবার সময় নিশ্চয় আপনার চা খেয়ে যাবো।’ এখানে আসার পর থেকে
পল্লী পাঠাগারটা দেখার জন্য মনটা উসখুস করছিল সবারই। সে-কথা লিখনকে জানাতেই সে নিয়ে
গেল পাঠাগারের দিকে। একটু দূরেই হাঁটাপথ, পল্লী পাঠাগার। পাঠাগারের নিজস্ব কোনো জমিজমা
নেই, নেই কোনও নিজস্ব ভবনও। স্থানীয় এক সহৃদয় ব্যক্তির দোকানঘরের পাশের একটা রুমে পরিচালিত
হয় পাঠাগারের কার্যক্রম। ছোট্টঘরটার দেয়াল জুড়ে এখানে সেখানে ঝুলছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,
জসিম উদদীন, জীবনানন্দ, শরৎ, সুকান্ত, শামসুর রাহমানের বাঁধানো ছবি। লাইব্রেরির সদস্য
সংখ্যা প্রায় আড়াই’শ, বই আছে ছয়শ’র ওপরে। ছোট ছোট গোটা দুই আলমারিতে বইগুলো সুন্দর
করে সাজানো, নিয়মিতভাবে পাঠকরা বই নিয়ে যায়। তাছাড়া অন্যান্য কার্যক্রমের ভেতর দেশের
বিশেষ দিবসগুলোতে অনুষ্ঠানের আয়োজন, নবীন লেখকদের জন্য দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
গরীব ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য বিনা বেতনে কোচিং-এর সুযোগ আছে, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক
কর্মকান্ডেও অংশগ্রহণ করে থাকে পল্লী পাঠাগারের সদস্যবৃন্দ। গ্রামেরই প্রবীন প্রাক্তন
শিক্ষক আফছার উদ্দিন মাস্টার পল্লী পাঠাগারের জন্য তিন শতক জমি দান করেছেন। সুনয়ন দেব
তথ্যটা শুনেই ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথাটা মাটির দিকে নোয়াল, যে গ্রামে একটা পাঠাগারের
জন্য এক ব্যক্তি আজকের বাজারে তিন শতক জমি দান করতে পারেন সে-গ্রামে একটা পাঠাগারের
উন্নয়ন হবে বা তার পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করবে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না।
দলবেঁধে সবুজ ঘাসের মাথায় পা
ফেলে ফেলে স্কুলের অফিসঘরের দিকে হেঁটে গেল ওরা, সেখানেই অতিথিদের বসার জায়গা। লিখন
পরিচয় করিয়ে দিল পাঠাগারের সভাপতি মহোদয়ের সঙ্গে, পেশায় শিক্ষকতা করেন ভদ্রলোক। ভীষণ
খুশি তিনি সেই অনুষ্ঠানে সুনয়ন দেবের স্বশরীরে উপস্থিত হওয়াতে। মঞ্চের কাছাকাছি দেখা
হল তার সঙ্গে শহিদুলের। নাসিরের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল তার। শহিদুল পাঠাগারের সাধারণ
সম্পাদক, ওকে দেখেই বোঝা গেল ওর ওপর দিয়ে অনুষ্ঠানের কী ঝড়টাই না বয়ে যাচ্ছে। হাতে
কাগজ-কলম নিয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে ঘেমে একাকার। তাদের দেখামাত্র ছুটে এসে হাতের সাথে
হাত মেলালো। কুশল বিনিময় শেষে ও লজ্জিতভাবে তাদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিল। অনুষ্ঠান
শুরু হতে একটু দেরি হবেÑ লিখন জানাল। এর মধ্যে একটা মাইক্রোবাস মাঠে ঢুকল। মাঠের সবুজ
ঘাস মাড়িয়ে গাড়িটা ঠিক তাদের সামনেই এসে দাঁড়াল। সড়সড় শব্দ করে গাড়ির গেট খুলে গেলে
লাল নীল সবুজ বেগুনি রঙের পরিষ্কার ধবধবে পাঞ্জাবি পরা একে একে ছয়জন ভদ্রলোক নামলেন।
প্রত্যেকেরই কাঁধে শান্তিনিকেতনি কিংবা দেশীয় চটের বিশেষ ধরনের ব্যাগ। সুনয়নের কানের
কাছে লিখন মুখ এনে বলল, ‘কবিরা এলেন’। লিখনের কথায় সুনয়ন দেবের মনোযোগ দ্বিগুণবেগে
তাঁদের দিকে ছুটল, চোখ দুটো একেবারে যেন সেঁটে গেল তাঁদের দিকেই। নির্মলেন্দু গুণের
মতো কারো লম্বা দাড়ি নেই, কিংবা মহাদেব সাহার মতো কাঁধ ছুঁই ছুঁই মাথার চুল, কিংবা
রুদ্রের মতো ছাঁটা চাপচাপ দাড়ি কিংবা মোহাম্মদ রফিকের মতো উন্নত গোঁফ! দু-একজনের গোঁফ
আছে বটে, সেটা স্বাভাবিক পর্যায়ে। তাছাড়া একেবারে ক্লিন সেভ, চকচকে মুখমন্ডল। গা থেকে
বিভিন্ন পারফিউমের ঘ্রাণ এসে নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। গাড়ির শব্দে স্কুলের অফিস ঘর থেকে
পাঠাগারের সভাপতি মহোদয় ছুটে এসে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন, সবাই সবার সাথে হাস্যমুখে
করমর্দন করলেন। সুনয়ন দেবের দিকে হাত বাড়িয়েও একে একে করমর্দনের সাথে তাঁদের নাম বলে
গেলেন, করমর্দনটা ঠিকমতো সে করতে পারলেও সেই মুহূর্তে নামগুলো আর তার স্মৃতিতে ধরে
রাখতে পারল না। হাস্যমুখে পরিচয়পর্ব শেষ করে ওদের সাথেই পেছনে পেছনে স্কুল ঘরের অফিসকক্ষে
সেও ঢুকল। তার পেছনে মাইক্রোবাসের ড্রাইভার দু’টো কার্টন নিয়ে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর লিখন
এসে জানাল এমপি সাহেব আসতে না-পারায় তার সহধর্মিনীকে পাঠিয়েছেন। সাথে দলের কিছু আঞ্চলিক
নেতা-কর্মীকে। এমপি সাহেবের সহধর্মিনীসহ অতিথিবৃন্দ অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরের ভেতর
থেকেই মাইকে শহিদুলের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।
অনুষ্ঠানের আঙ্গিনা ঘেরা থাকার
ফলে পুরুষ-মহিলাদের জন্য আলাদা জায়গা। সামনের কিছুটা জায়গা সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত।
কয়েকজনকে দেখা গেল স্যাটেলাইট টিভির ক্যামেরা মঞ্চের সামনে স্থাপন করে চোখ লাগিয়ে ছবি
ধারণ করতে। অনুষ্ঠান শুরু হলো রীতি অনুযায়ী অতিথিদের আসন গ্রহণ ও পরিচয় প্রদানের মধ্য
দিয়ে। এরপর সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রভাতী’র মোড়ক উন্মোচন প্রধান অতিথি এমপি সাহেবের সহধর্মিনীর
হাতে। এক কপি সুনয়ন দেবের হাতেও এসে পৌঁছল। স্টেজের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে নাসির, মহিদুল,
স্বরূপ নিচে দর্শকদের সামনে অতিথির আসনে বসা। সেখানে আগত কবিদলও, সবার মাঝে থেকে কেন
জানি কবিদলকে এক দেখাতেই সবার কাছ থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলা যাচ্ছে। একে একে আগত
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তৃতা, তারপর স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণও
বক্তব্য প্রদান করলেন। মাঝে মাঝে চলতে থাকে পল্লী পাঠাগারের পরিচিতি পর্ব ও সদস্যদের
পরিচয় এবং কার্যক্রমের বিবরণ প্রদান। সড়াবাড়িয়ার প্রাক্তন শিক্ষক আফছার উদ্দিন মাস্টার
খুবই সাদাসিধে ধরনের মুরুব্বী মানুষ, তাঁকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল, তাঁর সংক্ষিপ্ত
বক্তব্যে মুগ্ধ হল সুনয়ন দেব। তিনি পল্লী পাঠাগারের জন্য দান করা তাঁর তিন শতক জমির
ব্যাপারে কোনো কথাই বললেন না। এলাকার নবীন-তরুণদের কাছে একটা দাবীই করলেন, ‘সবাইকে
পাঠাগারে আসতে হবে, বই পড়তে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে।’ সামনের টেবিলে সারি সারি খয়েরি
রঙের ভেলভেটের কাপড়ে মোড়ানো বাক্সে কয়েকটা ক্রেস্ট। কিছুক্ষণের মধ্যে মাইকে ঘোষণার
পর পরই ‘অতিথি-কবিরা’ একে একে মঞ্চে উঠে আসলেন, প্রধান অতিথি এমপি সাহেবের সহধর্মিনী
ও সুনয়ন দেবের হাত থেকে তারা ক্রেস্টগুলো একে একে হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। মুহূর্তে ক্যামেরার
ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল থেমে থেমে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ছবি উঠানো শেষ হল ততক্ষণ পর্যন্ত অতিথি-কবিদের
হাতের সাথে ক্রেস্ট ধরে থাকতে হল। পল্লী পাঠাগারের জন্য অতিথি-কবিদের বই দান ও তাদের
স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে পশ্চিমের সূর্য ডুবতে থাকে। প্রধান অতিথি হিসেবে সর্বশেষে
বক্তব্য দিতে ওঠেন এমপি সাহেবের সহধর্মিনী। পাঠাগারের পক্ষ থেকে তার কাছে কিছু দাবী-দাওয়া
আগেই হয়ত জানান হয়েছিল। তিনি পল্লী পাঠাগারের উন্নয়নকল্পে এমপি সাহেবের পক্ষ থেকে এক
লক্ষ টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন। এঘোষণাকে মুহূর্তে উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন
জানাল। সুনয়ন দেবের কেবলই মনে হতে থাকল টাকাটা হাতে এলে লিখনদের পাঠাগারটার বেশ কাজে
লাগবে সন্দেহ নেই। তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল পল্লী পাঠাগার বাস্তুহীন ঘরÑ টিন
দিয়ে ঘেরা ঘর তড়তড়িয়ে ইটের ঘরে পরিণত হচ্ছে... মাথার উপরে সিলিং ফ্যান ঘুরে ঘুরে ঠান্ডা
বাতাস দিচ্ছে পাঠকদের... ঘরের দেয়াল ঘেঁসে সারি সারি বইয়ের র্যাক... নিজস্ব কম্পিউটার-
ইন্টারনেট-ওয়েবসাইট... আধুনিক একটা পাবলিক লাইব্রেরিতে পরিণত হচ্ছে পল্লী পাঠাগার!
সন্ধ্যার আযান ভেসে এলো। আযানের
পর সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। শহিদুলকে মঞ্চের
পাশে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটতে দেখে সুনয়ন ডাকল, বিদায় নেয়ার কথাটা ওকে বলতেই থাকার জন্য
অনুরোধ জানাল। অনুরোধটা সত্যি রাখা গেল না। এর মধ্যে তাদের সামনে কয়জন ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে,
লেখালেখি করে ওরা। ওদের চোখমুখে কৌতুহলের ছায়া। হয়ত জীবনের প্রথম এলাকার বাইরের কোনো
লেখককে দেখছে। ওদের সাথে কথা বলতে গিয়েই টের পেল সুনয়ন দেব তার অনুমান মিথ্যা না। কী
লেখেন, কবে থেকে লেখেন, বই কয়টা বের হয়েছেÑ এসমস্ত প্রশ্ন শুরু করল, উত্তরও দিল সে।
লেখালেখিতে দুই যুগ পার করে দেয়ার পরও বই প্রকাশের স্বল্পতা দেখে হয়ত ভেতরে ভেতরে কিছুটা
দমেও গেল বোধকরি ওরা। একজন তো বলেই বসল, ‘সামাদ ভাই তো এই বয়সেই আট-দশটা কবিতার বই
বের করে ফেলেছে!’ সামাদভাইটা কে? সুনয়ন অনেকবার মনে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে।
তখনও সুনয়ন দেবের দেখার অনেক বাকি। লিখন জানাল, ‘দাদা, আজ রাতটা যদি থাকেন তাহলে দেখবেন
অনুষ্ঠানে কতো লোক জমা হয়।’ সে মাঠের দিকে তাকাল, বিশাল আকৃতির মাঠ, সমস্ত মাঠে থৈ
থৈ করছে লোকজন। নসিমন/করিমের চড়ে এখনও লোক আসছে অনুষ্ঠানস্থলে। তারা মাঠের এক কোণে
একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়াল। চোখের সামনে কালো কালো শুধু মাথাই চোখে পড়ছে। মহিদুল বিস্ময়
প্রকাশ করে জানাল, একেবারে পল্টন ময়দান! তাদেরকে অনেক দূর যেতে হবে ভেবে তারা রওনা
দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকল। অতিথি-কবির দল ও বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ চলে যাচ্ছেন। মহিদুল
একটা করিমন ভটভটি গাড়ি ভাড়া করল। সেই মুহূর্তে লিখন জানাল, ‘দাদা এক কাপ চা খেয়ে গেলে
আব্বা খুব খুশি হতেন।’ মনে পড়ল, ওর বাবাকে কথা দিয়েছিল সে ফেরার পথে চা খাবে। ফের লিখনের
বাবার চায়ের স্টলে যেতে হল। ভদ্রলোক খুব খুশি মনে তাদেরকে বিস্কুট আর চা খাওয়ালেন।
তার আতিথিয়তাটুকুই গ্রহণ করল সে, ভদ্রতাবসত চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে তার মনে কষ্ট দিতে
ইচ্ছা করল না তার। চা খাওয়ার সময়ই সুনয়ন দেব শুনেছিল স্বরূপ তাদের সাথে যাচ্ছে না,
ও যাবে ওর বোনের বাড়িতে। সুনয়ন দেব নিজেসহ তিনজন ওকে ছাড়াই ভটভটিতে উঠল। একটা পাঠাগারের
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঘিরে এত ব্যাপক আয়োজন তার চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে, মন ভরিয়ে দিয়েছে।
শেষ বিকেলে ক্লান্তিও কম লাগেনি। আফসোস থেকে গেল রাতের অনুষ্ঠান না দেখায়। আরও একটা
আফসোস, লিখনের কাছেই শুনেছিলাম কাছেই এঅঞ্চলের প্রধান এবং প্রবীন গীতি-কবি মহর আলীর
বাড়ি, তিনি বর্তমানে এখানেই থাকেন। দেশজুড়ে তাঁর নাম, বড় বড় পুরস্কারে ভূষিত তিনি।
তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রবল ইচ্ছা সুনয়ন দেবের অনেকদিনের, দেখা করা হল না, সময়ের স্বল্পতা।
নিজেকে প্রবোধ দিল, প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি থাকে, আপাতত এটা মেনে নিয়েই
ফিরে যেতে হচ্ছে।
ভটভটি করিমনের টিমটিমে ছোট্ট
একটা বাল্বের চাপা লালচে আলোয় রাতের চাপ চাপ অন্ধকার কেটে তাদের নিয়ে চলল ফের সেই তিনমাথার
ছোট্ট বাজারটার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যারাতের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাপিয়ে ভটভটির ভটভট ছটফট
ভটভট ছটফট শব্দ বেজেই চলেছে একটানা। মাঝে মাঝে একটু ঝাঁকুনি যেন কল্পনার রাজ্য থেকে
বাস্তবে ফিরিয়ে আনছে সবাইকে। শেষবার চা খাওয়ার ফাঁকে লিখনের আড়ালে বলা কথাগুলো যেন
নতুন করে মনে বাজছিল সুনয়ন দেবের কানে, ‘আর বলবেন না দাদা, একটা অনুষ্ঠান করা যে কতখানি
ঝাক্কিঝামেলার কাজ! ঐযে মাইক্রো নিয়ে উনাদের আসা দেখলেন, উনাদের সবারই ইতোমধ্যে আটটা-দশটা
করে কবিতার বই বের হয়ে গেছে। যেনতেন প্রকার দাওয়াত দিলেই উনারা এভাবে হাজির হয়ে যান।
টাকা থাকলি যা হয় আর কী! উনারা কেউ রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন কেউ কেউ ঠিকাদারি করেন।
কবিতা লেখা, বই বের করা আর পুরস্কার নেয়া উনাদের কাছে এক একটা ফ্যাশান!... তবে আপনাকে
সম্মাননা দিতে পেরে আমরা খুশি।’ গাড়িতে বেশ চাপাচাপি করে বসতে হয়েছে। উঠার সময়েই নাসির
বলেছিল, ‘যদি কষ্ট হয় দাদা তাহলে ওটা না হয় আমার কাছে দেন।’ মহিদুলের কাছে ব্যাগ ছিল,
কবিদের কাছ থেকে পাওয়া বইগুলো বহনের ভার সে নিজেই আগ্রহ করে নিয়েছে। নাসিরের হাত একপ্রকার
খালিই ছিল, ফুলের তোড়াটা ও শুকে দেখার ছলে সেটা হাতে নিয়েছে তো ধরেই আছে। সংবর্ধনায়
দেয়া সিঁদুরের মত লাল রঙের ভেলভেট কাপড়ে মোড়ানো ক্রেস্ট-এর ছোট্ট বাক্সটা সেই থেকেই
সুনয়ন দেবের নিজের হাতে, গাড়িতে উঠার পর থেকে ঝাঁকি সামলিয়ে সেটা এক হাতে বুকের সাথে
ঠেসে ধরে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে। আর সেই থেকে বুকের মধ্যে যেন ধ্বক ধ্বক করে হৃদপিন্ডের
শব্দ নয়, হাজারও জনতার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেয়া করতালির শব্দই যেন বাজছে... একটানা বেজেই
চলেছে...!

Post a Comment