পৃথিবীতে সকল জাতিরই ধর্মীয় মূল
উৎসব রয়েছে। মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে এই ঈদুল ফিতর অন্যতম । ঈদ
ও ফিত্র দুটিই আরবী শব্দ। ঈদ এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। ফিত্র এর অর্থ বিদীর্ণ করা, উপবাস
ভঙ্গকরণ, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া প্রভৃতি বুঝায়। পবিত্র রমযান মাসে সিয়াম সাধনা
ও সংযম পালনের পর শাওয়াল মাসের ১লা তারিখে সিয়াম ভঙ্গ করে স্বাভাবিক কর্ম জীবনে ফিরে
যাওয়ার আনন্দময় দিবসটি ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত। পবিত্র রমযানের নতুন চাঁদ দেখে সিয়ামের
(রোযার) মাস শুরু হয় এবং শাওয়াল মাসের নুতন
চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ করা হয়। রোযার চাঁদ দেখার সাথে সাথে এদেশের বিভিন্ন মিডিয়া, পারিবারিক ক্যাসেট বা রেকর্ড
প্লেয়ারে বেজে ওঠে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর সেই অমর গান“ ও মন রমজানের ওই
রোজার শেষে/ এল খুশির ঈদ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে/ শোন আসমানী তাগিদ...। এ গান বাঙালি
মুসলমান নারীপুরুষের তনু-মনে এনে দেয় এক অফুরন্ত আনন্দের ঢেউ।
এ একমাস মুসলমানেরা ক্রোধ, কাম,
মদ, মোহ, মাৎসর্য সকল কু-প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখে। এ কারণে ফিত্র শব্দটি বিজয় অর্থেও
ব্যবহৃত হয়। ১¬‘ উৎসবের আনন্দ যাতে সমাজের সকল স্তরের লোক উপভোগ করতে পারেন সেজন্য
গরীব-দুঃখীর প্রতি সহানুভূতি ও ভাতৃভাব প্রকাশ করে সাদকায়ে ফিতরাহ দেয়া হয়। এই দিন
‘ঈদের নামাযের পূর্বে সঙ্গতিপন্ন স্বাধীন মুসলমানের পক্ষে সাদকায়ে ফিতরাহ দেয়া ওয়াজিব।‘ইদুল
আযহার নামাযের ন্যায় ‘ইদুল ফিতরেও ছয়টি অতিরিক্ত তকবীরের সাথে দুই রাকা‘আত ওয়াজিব নামায
জামা‘আতে পড়া হয় এবং দুইটি খুতবা পাঠ করা হয়। ঈদের নামাযের খুতবা শোনাও ওয়াজিব। মাঠে বা মসজিদে এ নামায
আদায় করা হয়। প্রথমে মসজিদ বা ‘ঈদের মাঠে যাতায়াতের সময় চুপে চুপে তকবীর বলা সুন্নত
। যে পথ ধরে নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদ বা ময়দানে যাওয়া হয়, ভিন্ন পথে বাড়ি ফেরাটা সুন্নত। তাকবীরকে তাকবীরে
তাশরীক বলে। তাকবীরে তাশরীক এমন: আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার , ইল্লাল্লাহু , আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।এই ‘ঈদুল ফিতরের দিন রোযা রাখা
হারাম।২ এ নামাযের সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে বেলা দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত এবং
বিশেষ কারণে প্রথম দিন নামায আদায়ে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় দিনও পড়া যায়। ঈদুল ফিতর নামাযে
আযানের-ইকামত কিছুই দরকার নাই।প্রথমে ইমাম তাকবীরে তাহরীমা বলে হাত বাঁধবেন। এ নামাযের
নিয়্যত হচ্ছে এমন: নাওয়াইতু আন্ উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআ’লা রাকআতাই সালাতিল
ঈদুল ফিতরি মাআ’সিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়জিবুল্লাহি তাআ’লা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার। নিয়্যত
করে আল্লাহু আকবার বলার সাথে সাথে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হয়। তারপর তাহরীমা বেঁধে সানা পড়তে হয়। সানা পড়ার পরই ইমাম-এর সাথে তিনবার
অতিরিক্ত তাকবীর বলতে হয় । এই তিনবারই কান পর্যন্ত হাত উঠাতে হয়। কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় বার তাকবীর বলে হাত না বেঁধে ছেড়ে দিতে
হয়। তৃতীয়বার তাকবীর বলে হাত বাঁধতে হয়। তারপর ইমাম সুরা ফাতিহা এবং অন্য কোনো সূরা পাঠ করেন। এরপর
ইমাম-এর সাথে মুসল্লিগণ রুকু এবং সিজদাহ করেন। এই সিজদাহর পর মুসল্লিগণ তখন উঠে দাঁড়ান।
দ্বিতীয় রাকআতেও ইমাম সুরা ফাতিহা
এবং অন্য কোনো সুরা পড়বেন। তারপর ইমামের সাথে মুসল্লিগণ তিনবার অতিরিক্ত তাকবীর বলেন।
এই তিনবারই কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হয়Ñহাত বাঁধতে হয় না। চতুর্থবারে ইমাম-এর
সাথে তাকবীর বলে রুকুতে যেতে হয়। তারপর সিজদাহ করে উঠে বসে তাশাহ্হুদ্ ,দরুদ এবং দুআ
মাসুরা পড়তে হয়। এরপর ইমাম-এর সাথে সালাম ফিরিয়ে এ নামায শেষ করা হয়।
এ মহান পূণ্যময় দিবস-উযাপন শুরু
হয় ১৩৮০ সৌর বছর আগে।‘ অনেকের মতে ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে বাংলাদেশে মুসলমান ছিল
না।’৩ পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যে সব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয় সেগুলির মধ্যে ঈদুল
ফিত্র হচ্ছে কনিষ্ঠতম। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত
মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মদীনাতে হিজরত-এর অব্যবহিত পরেই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়।হযরত
আনাস (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করিম (সাঃ) মদীনা আগমন করে দেখলেন
মদীনাবাসীগন দুই দিবসে আনন্দ-উল্লাস করে থাকে। মহানবী(সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, এ দিবসদ্বয়
কি? ওরা বলল, জাহেলী যুগ থেকেই এ দুটি দিবসে আনন্দ-উল্লাস করে থাকি। তখন রাসুলাল্লহ
(সাঃ) বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে উক্ত দিবসদ্বয়ের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন।
দিবসদ্বয় হলো ঈদুল আযহার দিবস ও ঈদুল ফিতরের দিবস।... ঈদুর ফিতর বাংলার প্রাচীন উৎসবগুলির
অন্যতম। বাংলাদেশে এ দিবসটি খুবই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়।গোসল ও অযু করে পাক পবিত্র
হয়ে সকলেই এদিনটিতে সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরেন এবং দেহে আতর ও কেউ কেউ চোখে সুরমা
ব্যবহার করেন। মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া মোস্তাহাব। এ দিন অধিকাংশ স্বচ্ছল বাড়িতেই শেমাইসহ
নানা উন্নতমানের খাবার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ‘আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের
অংশীদার হয়। পদমর্যাদা কিংবা বয়স নির্বিশেষে সকলে কোলাকুলিসহ সালাম বিনিময় করে। আত্মীস্বজন
ও পূণ্যবানদের কবর যিয়ারত করে।’ বর্তমানে ঈদকার্ড, মোবাইল ফোন বা টেলিফোন যোগে ঈদের
শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করাটা একটি জনপ্রিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। এদিনে সাধ্যমত খাদ্য, বস্ত্র
প্রভৃতি দান করা হয়ে থাকে। ‘বাংলাদেশের সর্বত্র ঈদ উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষ্যে সাধারণত
তিনদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।এর ফলে গ্রাম
প্রধান বাংলাদেশের শহরবাসীরা নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে
ঈদ উৎসব পালন করতে পারেন।১’ কিন্ত একসময় এই দিনে এ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের সে
সুযোগ ও পরিবেশ ছিল না। কারণ ‘১৮৭১ সালের পরেও কেবল বিচার বিভাগ ছাড়া শিক্ষাসহ সরকারী
বিভাগে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য কোনো ছুটির বরাদ্দ ছিল না। ১৮৯৩ সালে মুসলমানদের
জন্য বাংলা সরকারি কলেজের ছুটি ছিল এমন: ঈদুল ফেতর ১দিন, মহররম ২দিন, ফাতেহা দোয়াজ দাহম ১ দিন। ১৮৯৫ সালে বাংলা আর্টস
কলেজের ছুটি ছিল এরূপ: ঈদুল ফেতর ১দিন, মহররম
২দিন, ফাতেহা দোয়াজ দাহম ১ দিন এবং ১৮৯৮ সালে
উক্ত কলেজের ছুটির তালিকায়: মহররমÑএর ছুটি ২ দিনের স্থলে ১দিন করা হয়, ঈদুল ফেতর- ১দিন
, ফাতেহা দোজ দাহম- ১দিন ও ঈদুল আজহার জন্য ১ দিন ছুটি চালু করা হয়।’৫
যা হোক,ঈদ উৎসবে গ্রামবাংলার অনেক স্থানে ঈদের মেলা
বসে। মূলত পল্লীবাসীর এ এক মিলনমেলা। নদীতীরে,গ্রাম্য বাজারের নিকটে বটতলায় এসব মেলা
জমে ওঠে। মেলায় আসে লোকশিল্পজাত নানা পণ্যদ্রব্যএবং সাথে খাবার জিনিসও। ৪ যেমন: চিড়া,
মুড়ি, খাগরাই, দাঁতভাঙ্গা, খৈ, ম-া, মিঠাইসহ আরও কতো কিছু। এ ছাড়া পুতুল, বেলুন, বাঁশি, নকশি পাখা, রঙিন হাঁড়ি-পাতিল, ঢোল, একতারাসহ আরও নানা জিনিস। সেই
সাথে থাকে মনোরঞ্জনের জন্য নাগরদোলা, পুতুল নাচ এবং মারফতি, মুশিদিসহ আধ্যাতিক সঙ্গীতের আসর । বিভিন্ন
পত্রপত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশনে এদিনটির তাৎপর্যসহ প্রাসঙ্গিক বহুবিধ অনুষ্ঠানাদি
প্রচারিত হয়ে থাকে। এদেশের বড় বড় নদীতে চলে নৌকাবাইচ। এমন প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগিদের
উৎসাহদানের জন্য থাকে নানা পুরস্কার। এ ঈদ উপলক্ষ্যে কোথাও কোথাও আয়োজন করা হয় হা-ডু-ডু,
বদন, কাবাডি, ফুটবল ও ক্রিকেটসহ নানা খেলাধুলা।অবশেষে দিন গড়িয়ে যেয়ে আসে রাত, আর এভাবেই
সমাপ্তি ঘটে এ খুশির দিনটির । সংশ্লিষ্ট সবাই তখন আবার ফিরে যেতে থাকেন আপন আপন সেই কর্ম পরিবেশে।
সূত্র: লেখকের প্রকাশিতব্য “অন্তরে
ও বাহিরের নাটোর ” নামের ইতিহাস গ্রন্থের দ্বিতীয় খ- থেকে এ অংশটি প্রকাশ করা হলো।

Post a Comment