ছয়টি মোবাইল কোম্পানি বাংলাদেশের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। তারা কথা বলার জন্য টাকা নেয়। ভোজন বিলাসী বাঙালির আর একটি স্বভাব বেশি কথা বলা। বাঙালি কথা বলে পথে, হাটে, মাঠে, ঘাটে, টার্মিনালে, স্টেশনে, বন্দরে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, জাহাজে, দোকানে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে। কথা হয় প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। কথা বলে পিতা মাতা, ভাই বোন, নিকটাত্মীয়, দোকানি, শিক্ষক, বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, অফিসের বস-সহকর্মি সকলের সাথে। তো এই সুযোগে মোবাইল কোম্পানিগুলি হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মুঠোফোন। এখন দাও টাকা। টাকা দিতেও আপত্তি নেই মানুষের। কিন্তু এরপরেও নানা হেপা। নেটওয়ার্ক না পাওয়া ও কলড্রপ তো আছেই। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয় বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করা। অর্থাৎ ব্যবহারকারী তার মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত সিমটি পুনরায় রেজিস্ট্রেশন করাবেন সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরের কাছে। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় রি-রেজিস্ট্রেশন। মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১ মে। এরপরও ১ কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার সিম রি-রেজিস্ট্রেশন হয় নি।
এই পদ্ধতিতে রি-রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে মানুষকে যে কেমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে না। ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন শেখ ফিরোজ আহমদ বাবু। ‘কয়েকদিন আগে বনশ্রী মহল্লায় এক মোবাইল অপারেটরের কাছে যাই পিকনিক মুডে। শর্ত পূরণের সব উপাদানই তো সঙ্গে আছে। যেমন- আইড কার্ডের অরিজিনাল ও ফটোকপি, আর এক কপি ছবি। কোনও টেনশন নেই। আশা ছিলো সব কিছুই ঠিকমতো হবে। একই কাজে সাথে ছিলো ছোট ভাই শামিম। মেশিনে তার আঙুল দেয়ার পর প্রথমে হয় হয় করেও হচ্ছিল না। কী যন্ত্রণা! অপারেটরের পরামর্শে আঙুল মুছে নেয়ার পর কাজ হয়। এর মধ্যে লাইনে দুই মেয়ে ঢুকে পড়ে। তাদের বারণ করা যায় না। কী আশ্চর্য! ঝটপট ওদের কাজ হয়ে যায়। অবশেষে আমি এগিয়ে যাই। মেশিনে আঙুল রাখি। কিন্তু কাজ হয় না। নাম আসে, নম্বর আসে। কিন্তু বয়োমেট্রিক হয় না। একবার, দুইবার, তিনবারেও হয় না। অপারেটর বললো, আংকেল! আপনার আইডি কার্ডে সমস্যা আছে। আপনি গ্রামীণফেনের সার্ভিস সেন্টারে যান, এখানে হবে না। ভাবতে থাকি, আঙুলের ছাপ পড়লো না কেন? দোষ কার? ব্যাজার মুখে বাসায় ফিরি। গ্রামীণফোনের ১২১ নম্বরে ফোন করি। কি কি করতে হবে, সেই উপদেশ শুনি। স্বস্তি পাই। ড্রাইভিং লাইসেন্স নেইতো কী হয়েছে, একটা মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট আছে। ওটা দিয়েই কাজ হবে। খুঁজতে থাকি পাসপোর্ট। ড্রয়ার, আলমারি, ব্রিফকেস। দরকারের সময় কাজের জিনিস পাওয়া যায় না। ভিষণ গরম। ঘেমে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় মেহমান আসে। কী যে বিরক্ত লাগে। মুখে হাসি নিয়ে অভ্যর্থনা জানাই। ঘরে জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। তিনি বিষয়টি জানতে চান। ঘটনা শোনার পর তিনি বিদেয় হন। অবশেষে রাত দশটায় পাসপোর্টটি পাওয়া যায়। উল্লাসে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়। সবুজ রঙের এই নিরিহ পাসপোর্টটি ছিলো চোখের সামনেই একটি পলিথিনে মোড়ানো। পাসপোর্টতো পাওয়া গেলো, বিপদ অন্যখানে। পাতা জোড়া লেগে আছে। কিছুতেই খুলছে না। এখন উপায়! হঠাৎ মনে পড়ল, কোথায় যেনো দেখেছিলাম ‘এখানে পাসপোর্টের জোড়া লাগা পাতা খোলা হয়’। সকালে রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে দেখলাম লেখাটি। সেখানে একটি ফোন নম্বর দেয়া আছে। করলাম ফোন। ওপাশ থেকে জানানো হলো, মতিঝিল ইনকিলাব অফিসের পাশে আসুন। গেলাম সেখানে। কাজ হলো। তবে মজুরি নিলো সাত শ‘ টাকা। ছুটলাম গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে। অনেক ভিড়। অবশেষে একজনের হাতে ধরিয়ে দিলাম পাসপোর্ট। সে ওটার পাতা উল্টিয়ে বললো, মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট দিয়ে হবে না। শুনে আমার জ্ঞান হারনোর মতো অবস্থা। এখন কী হবে! বাসায় ফেরার পথে মালিবাগ আবুর হোটেলের পাশে একটি সার্ভিস সেন্টার দেখে ঢুকলাম ভেতরে। অবশেষে রি-রেজিস্ট্রেশন হলো ছয় মাসের জন্য। এরমধ্যে কি করতে হবে তাও সেন্টারের কর্মকর্তা নিজের হাতে লিখে দিলেন। এই সময় আমার মোবাইলে মেসেজ এলা ‘সাকসেসফুল’। আনন্দে আমার তখন নাচতে ইচ্ছে করলো। পরের মেসেজটি আসে ‘ইউ আর রেজিস্ট্রার্ড’। অতঃপর যুদ্ধ জয়ের সাফল্য নিয়ে বাসায় ফিরি।’
সিম অর্থাৎ সাবসক্রাইবার আইডেন্টিফিকেশন মডিউল হচ্ছে একটি লজিক্যাল এনটিটি, যার মাধ্যমে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলি কোনও ব্যবহারকারীকে শনাক্ত ও সেবা দান করতে পারেন। যেমন ভয়েস কল, ভিডিও কল, ইন্টারনেট ইত্যাদি। সিমকার্ড আসলে একটি ইলেক্ট্রনিক চিপ।
প্রশ্ন ওঠে, কেন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে? বিটিআরসি জানায়, সকলের ব্যক্তিগত পরিচিতি ও আঙুলের ছাপ সরকারের তথ্য ভা-ারে রাখার জন্য এই আয়োজন। এই সিম আর অন্য নামে ব্যবহার করা যাবে না। এই কথা স্বীকার করতে হবে, আগে কোটি সিম ভুয়া রেজিস্ট্রেশন ও ভিন্ন নামে কেনা হয়েছে। এবারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন সব সংযোগের রেজিস্ট্রেশন ফর্মের সাথে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হবে। একই সাথে নিজের আঙুলের ছাপ রেজিস্ট্রেশনকারীর কাছে থাকা ফিঙ্গার প্রিন্ট রিডিং মেশিনে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেসের কাছে তথ্যগুলো দিয়ে দেখে নেয়া হবে তথ্যগুলো নির্ভুল কিনা। যেসব ক্ষেত্রে নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে, সেগুলোরই রি-রেজিস্ট্রেশন হবে। এই পদ্ধতি সম্পন্ন হলে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে, ডুপ্লিকেট সিমকার্ডের সাহায্যে জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে, সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অবৈধ সিমের ব্যবহার বন্ধ হবে ও অবৈধ ভিওঅইপি কল টার্মিনেশন কমবে। কিন্তু নাগরিক অধিকারের স্পর্শকাতর এইসব অনেকটা উপেক্ষিত আছে বলে মনে করেন আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, ব্যক্তিগত সবকিছুর গোপনীয়তা সরকার দেশের স্বার্থে আইন দ্বারা ব্যতিক্রম করতে পারে। কিন্তু সিম বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ব্যাপারে কোনও আইন করা হয় নি।’ প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘এই তথ্য রাষ্ট্র ছাড়া কারও কাছে থাক নিরাপদ নয়। আঙুলের ছাপ তৃতীয় পক্ষের কাছে চলে গেলে নানারকম অপব্যবহার হতে পারে।’ বিটিআরসির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমদাদ উল বারী বলেন, ‘রিটেইলার লেভেলে সংরক্ষণ করার কোনও সুযোগ রাখা হয় নি। তবে অপারেটর লেভেলে এটা সম্ভব হতে পারে, যদি আলাদভাবে কেউ করে। তবে আমরা অপারেটরদেরকে নির্দেশ দিয়েছি, যেনো এটা তারা না করে।’ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তার ফেসবুকের পাতায় লিখেছেন, ‘মোবাইল কোম্পানির কাছে আঙুলের ছাপ সংরক্ষণের কোনও প্রযুক্তি নেই।’ অথচ বাংলালিংকের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শিহাব আহমাদ বলেন, ‘যে তথ্যগুলি আসছে তার সবই এখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ভেরিফাই হওয়ার পর বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী হয় সংরক্ষণ অথবা ডিলিট করা হবে। সংরক্ষণ না করে ভেরিফাই সম্ভব না।’
বিটিআরসির সর্বশেষ এপ্রিল মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ৬ মোবাইল অপারেটরের মোট গ্রাহক সংখ্যা ১৩ কোটি ১৯ লাখ ৪৯ হাজার। গত ৩১ মে বেধে দেয়া নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ১১ কোটি ২১ লাখ সিম রি-রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। অবশিষ্ট সিমগুলির সংযোগ আগামী দুই মাস পর্যন্ত জব্দ (ফ্রিজ) থাকবে বলে ঘোষণা করা হলেও বালাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ঐ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এখন যে কেউ ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দিয়ে বন্ধ সিমটি চালু করতে পারবে।
এতোকিছুর পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতগুলি সংযোগ নিতে পারবেন? তৈরি হয় নি ‘ট্রাভেলার সিম পলিসি’। ফলে সুযোগ থেকে যাচ্ছে একজন বিদেশি যতবার ভ্রমণে আসবেন ততবারই নিতে পারবেন নতুন সংযোগ। এছাড়া দেশ ত্যাগ করার পরও তার সিমটি চালু থাকবে। এমএনপি বা মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে কী সম্পূর্ণ হতে পারবে এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতি? যদি তা না হয় তো আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, মোবাইল ব্যবহারকারী অসৎ উদ্দেশ্যে অবৈধ সংযোগ নিয়ে চলে যেতে পারেন এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে।
রেজাউল করিম খান, সাংবাদিক, তারিখ: ০৯/০৬/১৬

Post a Comment