Halloween Costume ideas 2015

ভিতরে বাইরে ছন্দোময় কবি মোহাম্মদ আলী- বিপাশা চক্রবর্তী |

“উড়ে বেড়াও তুমি প্রজাপতির মতো। ফোটাও হুল মৌমাছির মতো” – মোহাম্মদ আলী।
তাঁর ঘুষির মতোই মুখের কথাও ঠিক মোক্ষম আঘাত হানতো। ঠিক সেখানেই দংশন করত যেখানটায় দরকার।
শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ। দক্ষ, দুঃসাহসী, উদ্যত এক মুষ্টিযোদ্ধা। হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। প্রতিপক্ষকে হাতের মুষ্টির আঘাতে আঘাতে ঘায়েল করে শারীরিক শক্তি আর সক্ষমতা প্রকাশ করার নিপুণ শিল্পী। এই খেলাকে তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে। আর কতখানি সফল হয়েছিলেন? এই প্রশ্নের জীবন্ত জবাব হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে মোহাম্মদ আলীর কোটি কোটি ভক্ত। বাংলাদেশ থেকে নাইজেরিয়া। আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য। মুষ্টিযুদ্ধের মতো খেলাকে অমানবিক আর নিষ্ঠুর আখ্যায়িত করে –তাঁকে নিয়ে সমালোচনাও করতে ছাড়েনি একদল মানুষ। অথচ এই মানুষটিই কিনা ছেলেবেলায় মায়ের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, “কেন যিশু সাদা? কেন সব ফেরেস্তারা সুন্দর”?- কেন আমার মতো কালো নয়? ১৯৯১ সালে টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ছেলেবেলায় মায়ের সাথে কথোপকথনের এই স্মৃতিচারণা করেন মোহাম্মদ আলী।
মার্কিন মুলুকের কেনটাকি প্রদেশের লুইভিলা শহরে জন্ম নেয়া এই কালো ছেলের কন্ঠনিসৃত অভিব্যক্তি যে একদিন বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের চেতনা হবে, তাদের হৃদয়ের কথার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজবে, কে জানত?
যেমন করে বক্সিং রিংয়ের ভেতরে তিনি যুদ্ধ করতেন, তেমন করেই রিংয়ের বাইরেও যুদ্ধ করে গেছেন। তবে এখানে তাঁর অস্ত্র ‘মুখবিবর’ আর ‘কন্ঠস্বর’। নাটুকে বাচনভঙ্গির জন্য তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। আলীর ভালবাসা ছিল ভাষার প্রতি। ছিল ভাষাগত দক্ষতাও। মৌখিক চতুরতায় এমনই পটু ছিলেন যে রিঙয়ের বাইরেও তিনি কথার যাদুতে আটকে রাখতেন দর্শক শ্রোতা ভক্ত সমালোচক নিন্দুক সব্বাইকে। শব্দের পর শব্দ গেঁথে এমন ছন্দময় করে এক একটি বাক্য বলতেন যে, প্রায়ই তা হয়ে উঠত কবিতার মতো।
ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র তখনো মোহাম্মদ আলী হয়ে ওঠেননি। তবে শারীরিক নৈপুণ্য আর শক্তি প্রদর্শনে সেরাদের সেরা হিসেবে খ্যাতি পেয়ে গেছেন। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘স্টিভ এলান শো’ তে উপস্থাপকসহ অসংখ্য দর্শককে তাঁর কথার শৈলিতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন।
এই শোতে বলেন, “আমার একটি পছন্দের কবিতা আছে যা কিনা আমার মতোই মহান! সর্বকালের সেরা ছোট্ট কবিতা, “আমি! হুইইই”! (আনন্দ প্রকাশের শব্দ)
আরো একটি ছোট ছড়া কাটেন, সামনেই লড়বেন বক্সার সনি লিসন-এর সাথে-
“ তুমি যদি তোমার টাকা খুইয়ে বোকা বনতে চাও, তবে সনি’র পক্ষ নাও” (সনির পক্ষে বাজি ধরার কথা বলছেন)
এভাবেই সব সময় মোহাম্মদ আলী সবাইকে তাঁর কথার ছন্দে মাতিয়ে রাখতেন। মুষ্টিযোদ্ধার মতো পেশাদার একজন লড়াকু হয়েও তিনি নিজেকে কঠিন আর রুক্ষ-কর্কশ মানবে পরিণত করেনি। এখানেই লুকিয়ে আছে আপামর জনতার কাছে তার অসম্ভব জনপ্রিয়তার মহত্ব।
“আলী সেরা লড়াইতে, তাঁর আছে গতি আর সহনশীলতা-
তুমি যদি তাঁর সাথে লড়তে চাও,
সবার আগে তোমার বীমা বাড়িয়ে নাও”
আত্মবিশ্বাসী আলী এমন আরো অনেক ছোট ছোট ছড়ার মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। যা ভক্তদের মুখে মুখে ফিরত। একবার ব্রিটিশ বক্সার হেনরি কুপার-এর সাথে লড়াইয়ের আগে নিজের জয় সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, বলেছিলেন- “হেনরি, বাজে বকার নেই তো সময়, খেলা হবে শেষ ঠিক পাঁচটায়”। সে সময় বাক্যটি রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে পড়ে। আলী মুখে মুখে অনেক কবিতা তৈরি করতেন তবে সেগুলি বেশিরভাগই অলিখিত থেকে যেত। কিছু কিছু লিখে রাখতেনও। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যেত, সেগুলি জনপ্রিয় হচ্ছে কোন রেডিও, টেলিভিশন বা পত্রিকার মতো গণমাধ্যমগুলোর কল্যাণে।


betle.jpg
বিখ্যাত গানের দল বিটলদের সাথে মোহাম্মদ আলী

“শব্দ ব্যবহারে তাঁর আশ্চর্যজনক বিচক্ষনতা ছিল, যে কেউ তা খতিয়ে দেখতে পারে”-বলেছেন লেখক জনাথন এইগ যিনি মোহাম্মদ আলীর জীবনী লিখছেন। জনাথন আরো বলেন,আলী ছাত্র হিসেবে কখনোই ভাল ছিলেন না। সেন্ট্রাল হাই স্কুলে পড়ার সময় অনেক শিক্ষক মনে করতেন, তাঁকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেয়া উচিত হবে না, কারণ বক্সিং টুর্নামেন্টের জন্য যথেষ্ট সময় দিতে গিয়ে প্রায়ই তাঁকে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে হতো। তবুও শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবেই হোক না কেন তাঁর জন্য ডিপ্লোমা ডিগ্রিটি বরাদ্দ হোক”।
মোহাম্মদ আলী কিভাবে পড়াশোনার মত কঠিন কাজটি উতরে যেতেন, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে আলীর স্ত্রী লোনী দশ বছর আগে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, “তিনি সবকিছু মনে রাখতে পারতেন, আর সেজন্যই কবিতায় এত ভাল দখল ছিল”।
১৯৪২ সালে জন্ম নিয়ে ১৯৭২ এ সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ‘হিরো’ হয়ে ওঠা আলী জানতেন কিভাবে মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হয়। তিনি ছিলেন একজন ঝানু অভিনেতা আর কৌতুকপ্রিয় মানুষ। একইসাথে সক্রিয় এবং শক্তিমান একজন বক্তা। একারণেই তিনি বুঝতেন কোন কথাটি মানুষকে হাসাবে। বাক্যের কোথায়, কতটুকু থামতে হবে। সেগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এতটাই দক্ষ ছিলেন যেমনটি ছিলেন বক্সিং-এ তাঁর বিখ্যাত জাব বা ধাক্কা দেয়ার ক্ষেত্রে। একসময় আলীর উক্তিগুলো রাজনৈতিক দিগদর্শনমূলক হয়ে পড়ে। বিশেষকরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যখন একজন আমেরিকান যুবক হিসেবে তার কাছে যুদ্ধে যোগদেবার সরকারী আহ্বান আসে। তখন বয়স মাত্র পঁচিশ, তিনি উচ্চকঠে তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘কেন তাদের দিকে গুলি ছুঁড়ব? ভিয়েত কং-এর কেউ আমাকে ‘নিগার’ বলেনি। আমাকে বেআইনি ঘোষণা করেনি’।
ফলাফল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফলতম সময়ে তিন বছর ছয়মাসের জন্য নিষিদ্ধ হওয়া। আলীর ওই উক্তি ক্ষেপিয়ে তুলেছিল কিছু আমেরিকানদের। বলা ভাল, শ্বেতাঙ্গদের। যে আলী রিংয়ের ভেতরে একজন অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা, সেই একই আলী রিংয়ের বাইরে হয়ে ওঠেন যুদ্ধবিরোধী প্রতীকী শক্তি। বর্ণবাদীদের চোখের বিষ। পরে অবশ্য আমেরিকান সরকার সুপ্রিমকোর্টে তার আপিলের বিরুদ্ধে আর যেতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে দেয় কেড়ে নেওয়া সম্মান। আবার বক্সিং-এর মঞ্চে ফিরে আসেন আলী। এবার তিনি সত্যি সত্যি মোহাম্মদ আলী। আমেরিকান ইসলামী সংগঠন ‘নেশন অব ইসলাম’এ যোগদান করে নাম পরিবর্তন করে ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে হয়ে যান মোহাম্মদ আলী। ঐ সময় তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে থাকার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে দাবী করেন, তার নতুন ধর্ম বিশ্বাসকে। তিনি দাবী করেন তাঁর ধর্ম ইসলাম এই অনৈতিক যুদ্ধে যাওয়া থেকে তাঁকে বিরত রেখেছে।
ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে একজন মোহাম্মদ আলী হয়ে ওঠবার জন্যও তাঁকে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। ঐ সময় বক্সিং রিংয়ে তিনি ভক্ত দর্শকদের উদ্দেশে প্রায়ই চিৎকার করে বলতেন “হোয়াটস মাই নেম”!“হোয়াটস মাই নেম”! বার বার বলতেন। কেননা তখনো তাঁকে পত্রিকা বা টেলিভিশনে ক্যাসিয়াস ক্লে বলেই সম্বোধন করা হতো। এমনকি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আলীর সাথে ছিলেন আরেক মুষ্টিযোদ্ধা এরনি ট্রেরল। টিভি ক্যামেরার সামনেই যিনি বার বার পুরোনো নাম ‘ক্লে’ বলে ডেকে যাচ্ছিলেন। আলী তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর নতুন নাম মোহাম্মদ আলী। তারপরেও এরনি আগের নামেই ডাকছিলেন। শেষ পর্যন্ত আলী তাঁকে কষে চড় মারার আগে বলে উঠেন, “আমার নাম মোহাম্মদ আলী, তুমি এই মুহূর্তেই তা ঘোষণা করবে, এখানে ঠিক রিংয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে”। পুরো ঘটনাটি ক্যামেরা বন্দী হয়েছিল তখন।
এমনই ছিলেন মোহাম্মদ আলী। জন্মবিদ্রোহী নৈতিকতায় অটল চিরকালীন এক যোদ্ধা। বক্সিং-এর রিংয়ে সে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভৎসর্না করতেন ছন্দে ছন্দে। আবার রিংয়ের বাইরে গর্জে উঠতেন একই সুরে। আলীর ছন্দে মুগ্ধ অনেক কবিই তাঁর কবিতার পংক্তিকে নিজের কবিতার মধ্যে দেখতে চাইতেন । যেমন- কবি মায়া এঙ্গেলেস। কবি ও সমালচক এডমন্ড উইলসন যথার্থই বলছেন,- “আমাদের কিছু ফোক সঙ্গীতে নিখাঁদ কিছু কবিতার পংক্তিমালা ব্যবহার করেছি, যেগুলিতে উৎসাহের মন্ত্র থাকতো যেমনটি আলীর কাব্যশক্তিতে ছিল”।
আলী যখন বলে ওঠেন, “আমার ছিল হাতকড়া বিদ্যুতচ্চমকের, তাই বজ্রকে নিক্ষেপ করেছিলাম কারাগারে” তখন তা হয়ে ওঠে মানুষের অদম্য সাহস আর আত্মবিশ্বাসের প্রতিধ্বনি। আবার যখন বলেন, “যতদূর আমি দেখতে পাই/ মরণপণ যুদ্ধ ছাড়া মুক্তি নাই/ আর কতখানি হলে হবে জুতসই, হবে যুদ্ধের শেষ”?-এভাবে আলী হয়ে ওঠেন নিপীড়িত বঞ্চিত সমাজের অবহেলিত মানুষের কণ্ঠস্বর। যা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে বার বার বেজে ওঠে দক্ষিণ আর পূর্ব এশিয়ার বস্তিগুলিতে, আমেরিকা ছাড়িয়ে তা চলে যায় আফ্রিকার গ্রামগুলিতে। বক্সিং’এর মঞ্চে যেমন ভ্রমরের ন্যায় ছন্দে ছন্দে ঘুরে বেড়াতেন তেমনি কবিতা, ছন্দ, শব্দমালা তাঁর মুখে খুঁজে ফিরত আনন্দ, কখনো অনুপ্রেরনায় আবার কখনো সকল বৈষম্য আর অন্যায়ের বিপরীতে।
আশির দশকের গোড়ার দিকে বক্সিং’এর রিং থেকে অবসর নেন আলী। পারকিনসন রোগ বাসা বেধেছিল শরীরে। ধীরে ধীরে বাকশক্তিও হারাচ্ছিলেন। খেলার শক্তি, কন্ঠের শক্তি হারিয়েও তিনি ছিলেন মানুষের মনের রাজা। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকলেও মানুষ তাঁকে ভোলেনি। সর্বশেষ ফোবর্স ম্যাগাজিনের জরিপে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর পাশেই ছিলেন। পারকিনসন রোগের প্রভাবে শ্বাসতন্ত্রে জটিলতা দেখা দেয়, আর এই অসুখেই গত তিন জুন চিরবিদায় নেন এই শ্রেষ্ঠ বীর। তাঁর জীবনের শেষ মিছিলে তাই লাখো কন্ঠের ধ্বনি, আলী ,আলী! ক্লে’কে ভুলে গেছে সবাই, বেঁচে আছে- আলী! আলী দ্য গ্রেট।
আলীর মৃত্যুর একবছর আগে সাংবাদিকদের কাছে স্ত্রী লোনী জানিয়েছিলেন, আলী নাকি তাকে বলেছিলেন এই কথাগুলো - “ আমি কখনো বলিনি আমি খুব বুদ্ধিমান ছিলাম, আমি বলেছিলাম, আমি শ্রেষ্ঠ ছিলাম”। মোহাম্মদ আলী কি জানেন তিনিও আজও শ্রেষ্ঠ হয়েই আছেন।

তথ্যসুত্র - নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, সিবিএসনিউজ, এনপিআর, পোয়েট্রি সুপ।
 

Post a Comment

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget